গৌরনদীতে দুলাল হত্যায় জড়িতরা এখনও অধরা!

প্রথম পাতা » বরিশাল » গৌরনদীতে দুলাল হত্যায় জড়িতরা এখনও অধরা!
শুক্রবার ● ১২ আগস্ট ২০২২


গৌরনদীতে দুলাল হত্যায় জড়িতরা এখনও অধরা!

গৌরনদী (বরিশাল) সাগরকন্যা প্রতিনিধি॥

বরিশালের গৌরনদী উপজেলার পূর্ব চরশরিকল গ্রামের বিত্তবান ও ব্যবসায়ী দুলাল চন্দ্র শিকদার (৬৮) হত্যার সাথে জড়িত মূলহোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে। এমন দাবি করছেন মামলার বাদি ও নিহতের পরিবারের স্বজনরা। পিবিআই-এর দেওয়া অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে মামলার বাদি অশোক শিকদার নারাজি দিলে দুলাল হত্যা মামলাটি পুনর্রায় তদন্তের জন্য সিআইডি’কে দির্দেশ দিয়েছে আদালত। মূলত স্থাণীয় একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠী সম্পত্তি দখলের জন্য পরিকল্পিতভাবে দুলাল চন্দ্র মিকদারকে হত্যা করেছে বলে নিহতের স্বজনরা ধারনা করছেন।
সরেজমিনে স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা বলে জানাগেছে, উপজেলার পূর্ব চরশরিকল গ্রামের বিত্তবান ও ব্যবসায়ী দুলাল শিকদার একাই বাড়ির দোতলা ভবনে বাড়ির কেয়ার টেকার হানিফ ফকির (৬০)কে নিয়ে বসবাস করতেন। লেখাপড়া করার জন্য দুলাল চন্দ্র শিকদারের স্ত্রী ও সন্তান ভারতে থাকেন। ব্যবসায়ী দুলালের ৫ ভাই ও ২ বোনের মধ্যে দুলাল ছিলেন মেঝা। তার সেঝ ভাই অনুপ শিকদার ভারতে থাকতেন। সেখানেই তিনি মারা গেছেন। অন্য ৩ ভাই চাকরির সুবাদে ঢাকায় থাকেন। তার বিবাহিত ২ বোন স্বামীর সঙ্গে  শ^শুর বাড়িতে থাকেন। দুলাল চন্দ্র শিকদার ভারত ও বাংলাদেশে নিয়মিত যাওয়া-আসা করে তাদের বাড়ির সম্পত্তি দেখাশোনা করতেন। দুলাল চন্দ্র শিকদারের কাছ থেকে এলাকার মানুষ সুদে লাখ লাখ টাকা নিতো। কারা কত টাকা নিতেন তা একটি রেজিস্টার খাতায় লিখে রাখা হতো। দুলাল চন্দ্রের অনুপস্থিতিতে বাড়ির কেয়ারটেকার হানিফ ফকির সে-ই সুদের  টাকা তুলতো  ও সবকিছু দেখাশোনা করতেন।  আর দুলাল চন্দ্র বাড়িতে এলে প্রতিবেশী নন্দ রানী ঘরামী (৬৩) ও শান্তনা মজুমদার (৪৫) তার রান্নাবান্নার কাজ করে দিতেন। ২০২১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ৮টার দিকে সুরেন শিকদারের হাট  থেকে দুলাল শিকদার বাড়ির কেয়ার টেকার হানিফ ফকিরকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরে। পরদিন ২৩ ফেব্রুয়ারি সকালে কেয়ার টেকার হানিফ ওই বাড়িতে গিয়ে ভবনের নিচতলার কিচেন রুমে দুলাল মিকদারের মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখেন।
নিহত দুলালের ছোট ভাই বাবুল চন্দ্র শিকদার বলেন, ২০২১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে আমার মেঝ ভাই দুলাল চন্দ্র শিকদারকে পরিকল্পিত ভাবে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। এ সময় খুনিরা ভাই’য়ের (দুলাল) ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি, জমির দলিল-পরচা, টাকার হিসাব-নিকাশের খাতা ও কয়েক লাখ টাকাও লুট করে নিয়ে যায়। দুলালের লাশ উদ্ধারের দিন ভবনের রান্নাঘরের রক্তাক্ত মেঝে লুঙ্গি দিয়ে মোছা ছিল। তার (দুলাল) মুখেও আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। ঘটনার দিন ভবনের নিচতলার পিছনের একটি দরজাও খোলা পাওয়া যায়। এত আলামত থাকার পরও পুলিশ এটিকে শুরুতে হত্যাকা- বলতে চায়নি। তখন পুলিশের ইচ্ছাতেই ওইদিনের প্রত্যক্ষদর্শী এক ব্যক্তিকে দিয়ে একটি অপমৃত্যুর মামলা নেয় পুলিশ। ঘটনার ১৮ দিন পর আমার সহোদর ভাই অশোক শিকদার বাদি হয়ে অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে গৌরনদী থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
জানাগেছে, বরিশাল জেলা পিবিআই মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর প্রথমে পরিদর্শক মাহফুজুর রহমান তদন্ত শুরু করেন। তিনি তথ্য-প্রযুক্তির সহায়তায় ২০২১ সালের ১০ মার্চ  কালাম দালালকে গ্রেফতার করে। তার বাড়ির রান্নাঘরের ছাইয়ের ভেতর থেকে দুলাল চন্দ্রের মোবাইলের পোড়া অংশ উদ্ধার করেন। একই বছরের ১৩ মার্চ কালামের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে স্বপন জমাদ্দার ও মোমিন আকনকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমানের বদলি হলে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পায় এসআই প্রতুল কুমার শীল। তদন্তকারী কর্মকর্তা কোনও আসামিকে রিমান্ডে নেয়নি। কোনও আসামি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দেয়নি। ঘটনার এক বছর পর ২০২২ সালের ১৩ মার্চ বরিশাল আদালতে কামাল দালাল ও স্বপন জমাদ্দারকে আসামি করে চার্জশীট দেয়। তারাই দুলাল চন্দ্রকে পরিকল্পনা করে হত্যা করে বলে চার্জশীটে বলা হয়। এদিকে, কালাম দালালের দেওয়া তথ্যে স্বপন ও মোমিন আকনকে গ্রেফতার করা হলেও অভিযোগপত্র থেকে মোমিন আকনকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
মামলার বাদি আশোক শিকদার বলেন, বাড়ির কেয়ার টেকার হানিফ ফকির আমার ভাই’র  টাকা পয়সা, আমাদের জায়গা জমিসহ সকল কিছু দেখভাল করতো। চার্জশিটে থাকা আসামিদের সঙ্গেও তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। মামলার পর থেকেই হানিফ ফকিরকে গ্রেফতারের দাবি করলেও পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেনি। পরিবার বলছে, অথচ এলাকায় সুদে লাগানো লাখ-লাখ টাকার তথ্য জানতো হানিফ ফকির। এমনকি হানিফের ভাই হারুন ফকিরকেও অর্থ সহায়তা করতেন দুলাল চন্দ্র। তিনি খুনের শিকার হওয়ায় সেসব টাকা আর ফেরত দিতে হয়নি।
নিহতের ভাই বাবুল শিকদার আরও বলেন, ‘আমার ভাই খুন হওয়াতে তারা লাভবান হয়েছে, তবে পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করেনি। উল্টো তাকে সাক্ষী বানানো হয়েছে।’ দুলাল চন্দ্র শিকদারকে হত্যার আগে ১৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ২২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মাত্র চার দিনে কেয়ারটেকার হানিফ ফকির, হিমু (স্থানীয় এক ব্যক্তি) ও অভিযোগপত্রে থাকা স্বপন জমাদ্দারের মধ্যে ১৫ থেকে ২০ বার মোবাইল ফোনে কথা হয়। অভিযোগপত্রে স্বপন জমাদ্দারের নাম আসলেও এই বিষয়টিও আমলে নেয়নি তদন্ত কর্মকর্তা।
পিবিআইর তদন্ত কর্মকর্তা চার্জশীটে উল্লেখ করেছেন, স্বপন ও কালাম দালাল প্রথমে চড়থাপ্পড় মারেন, এরপর মাথায় আঘাত করেন। কিন্তু কী দিয়ে মাথায় আঘাত করেছেন তা উল্লেখ নেই।
ময়নাতদন্ত রিপোর্ট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দুলাল শিকদারের মাথার ভেতরে মস্তিষ্কে মারাত্মক ইনজুরি ছিল।
বাবুল শিকদার অভিযোগ করে আরো বলেন, ঘটনার দিন রাত সাড়ে ১১টা থেকে ১২টার মধ্যে আমাদের বাড়ির পূর্ব-দক্ষিণ পাশে পানের বরজের পাহারাদার শ্যামল ম-ল অভিযুক্ত কালাম দালাল, স্বপন জমাদ্দার, মোমিন আকনসহ আজাহার ও এখলাস নামে আরও দুই জনকে একসঙ্গে হেঁটে যেতে দেখেন। এই বিষয়টি তদন্তকারী কর্মকর্তাকে জানালেও এ বিষয়ে তিনি গুরুত্ব দেন।ি তাদের জিজ্ঞাসাবাদও করেননি। এই পাঁচ জনের মধ্যে চার্জশীটে শুধু কালাম দালাল ও স্বপন জমাদ্দারের নাম আছে।
তদন্ত শেষে প্রথম চার্জশীট দেওয়া কর্মকর্তা ও পিবিআই’র এসআই এসআই প্রতুল কুমার শীল বলেন,  চার্জশীটভূক্ত আসামি কালাম দালালের ভাবি সাক্ষী রহিমা বেগম আদালতে স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। নিহত দুলাল শিকদারের লুন্ঠিত ১টি মোবাইল ফোনের একাংশ উদ্ধার করা হয়েছে। কিন্তু লুন্ঠিত নগদ টাকা, জমির দলিল ও হিসাব নিকাশের খাতাসহ লুন্ঠিত মালামাল উদ্ধারের যথেষ্ট চেষ্টা করা হয়েছে। তবে সুনিদিষ্ট তথ্য না পাওয়ায় উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। প্রাথমিক ভাবে আমার কাছে যা সত্য প্রমানিত হয়েছে, সেই ভাবেই আদালতে মামলার চার্জশীট দাখিল করেছি। তদন্তের কোন অংশ নিয়ে যদি বাদির সন্দেহ কিংবা প্রশ্ন থাকে তাহলে বাদি চার্জশীটের বিরুদ্ধে নারাজি দিতেই পারে।
দুলাল হত্যা মামলার বর্তমান তদন্তকারী কর্মকর্তা ও বরিশাল সিআইডি’র ইন্সপেক্টর মো. নুরুল আমিন বলেন, ইদানিং (অল্পদিন) আমি মামলার তদন্তের দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। এখন তদন্ত চলছে।

এআর/এমআর

বাংলাদেশ সময়: ২০:১৩:৫০ ● ১০৯ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ