চরফ্যাশনের বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পর্যটন খাতে নবদিগন্তের সূচনা

প্রথম পাতা » ব্রেকিং নিউজ » চরফ্যাশনের বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পর্যটন খাতে নবদিগন্তের সূচনা
রবিবার ● ৪ মে ২০২৫


চরফ্যাশনের বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পর্যটন খাতে নবদিগন্তের সূচনা

আমির হোসেন, চরফ্যাশন (ভোলা) সাগরকন্যা প্রতিনিধি॥

উপকূলীয় এলাকা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ঢালচর, চরকুকরি মুকরি, চরপাতিলা, ও চরমন্তাজে যাতায়াতে আগের মতো বিঘœ ঘটছে না। এতে ওই অঞ্চলের পর্যটক, ব্যবসায়ী ও কর্মজীবী মানুষের মাঝে উচ্ছাস দেখা গেছে। ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার দক্ষিণ আইচা থানার চরকচ্চপিয়া লঞ্চঘাট থেকে প্রতিনিয়ত নৌপথে ৪ টি রুটে ৯ টি লঞ্চ চলাচল করছে। এছাড়াও যাত্রী পারাপারের জন্য ১০ টি স্প্রীড বোডের ব্যবস্থাও রয়েছে। এসবকে ঘিরে চরগুলোতে অর্থনীতি এবং চরের পর্যটন খাতে নতুন দিগন্তের সূচনা সৃষ্টি হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চরফ্যাশন উপজেলার বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ঢালচর, চরকুকরি-মুকরি, চরপাতিলা, এবং পটুয়াখালী জেলার বাউফল উপজেলার চরমন্তাজ সহ ৪ টি দ্বীপে কয়েক লাখ মানুষের চলাচলের একমাত্র মাধ্যম হলো নৌপথ। এসব অঞ্চলের মানুষের যাতায়াত ও পণ্য আনা-নেওয়া হয় ট্রলার বা লঞ্চে করে। সেই সুবাদে ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে ৪ টি দ্বীপে দৈনিক একটি করে ৪ টি লঞ্চ তাদের নিধারিত সময়ে চলাচল করে আসছে। এতে পর্যটক, ব্যবসায়ী ও কর্মজীবী মানুষ সঠিক সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারতো না। এসব অঞ্চলের মানুষের দুর্ভোগের কথা ভেবে গত ৫ আগষ্টের পর বিআইডব্লিউটিএ থেকে রুটপারমিট নিয়ে আরও ৫ টি লঞ্চ চালু করেছেন স্থানীয়রা। বর্তমানে চরকচ্ছপিয়া লঞ্চঘাট থেকে ৯ টি লঞ্চ চলাচল করছে।
সরেজমিন উপজেলার দক্ষিণ আইচা থানার চরকচ্ছপিয়া লঞ্চঘাটে গিয়ে দেখা যায়, বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ঢালচরে ছেড়ে যাওয়ার জন্য এমএল ঢালচর নামের এক তলা একটি লঞ্চ এবং চরকুকরি-মুকরিতে ছেড়ে যাওয়ার জন্য এমএল সুফিয়া নামের এক তলা একটি লঞ্চ ঘাটে প্রস্তুত রয়েছেন। এবং চরপাতিলা ছেড়ে যাওয়ার জন্য এমভি মাসরাহ নামের এক তলা একটি লঞ্চ এবং চরমন্তাজে ছেড়ে যাওয়ার জন্য এমএল নিপু নামের এক তলা একটি লঞ্চ ঘাটে প্রস্তত রয়েছে। এসব লঞ্চগুলোতে যাত্রীরা কেউ উঠছেন আবার কেউ মালামাল ওঠাচ্ছেন।
এসময় লঞ্চযাত্রী চরকুকরি-মুকরির বাসিন্দা মো. ফয়েজ ও মো. মঞ্জুরুল আলম জানান, বিচ্ছিন্ন দ্বীপ চরকুকরি-মুকরি হলো একটি পর্যটন এলাকা। এখানে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন শহর থেকে প্রতি বছরে কয়েক লাখ পর্যটক ঘুরতে আসেন। বিশেষ করে এই দ্বীপে পর্যটক, ব্যবসায়ী ও কর্মজীবী মানুষের যাতায়াতের জন্য দুইটি লঞ্চ এবং ৫টি স্প্রীড বোড ছিলো। তাদের নিধারিত সময় ছাড়া তারা লঞ্চ ছাড়তো না। এতে যাত্রীরা ভিড়াম্বনায় পরতেন। এবং সঠিক সময়ের মধ্যে যাত্রীরা গন্তব্যে পৌছাতে পারতো না। এছাড়াও চরকুকরি-মুকরিতে উৎপাদিত কৃষিপণ্য এবং সমুদ্র থেকে আহরিত ইলিশ সহ অন্যান্য প্রজাতির মাছ ঢাকায় পাঠানো সম্ভব হতো না । বর্তমানে স্থানীয়দের উদ্যোগে আরও ২ টি ১ তলা বিশিষ্ট লঞ্চ যুক্ত হয়েছে। এসব লঞ্চগুলো এক ঘন্টা পরপর আসা-যাওয়া করে। এতে পর্যটকসহ ব্যবসায়ীরা ঝুঁকি মুক্ত ও সঠিক সময়ের মধ্যে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেন।
তারা আরো জানান, লঞ্চ চালু হওয়ায় চরকুকরি-মুকরির ব্যবসা-বাণিজ্যে ও পর্যটন খাতে এক নতুন দিগন্তের সূচনা হয়েছে। ফলে পিছিয়ে পড়া এই দ্বীপের অর্থনীতির চাকা আরো গতিশীল হবে।
চরকুকরির ব্যবসায়ী আলমগীর বলেন, নতুন করে আরও ২ টি লঞ্চ চালু হওয়ার খবর শুনে এই দ্বীপের ব্যবসায়ীরা খুশি। কারণ ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে তাদের পণ্য আনতে এখন ঝামেলা পোহাতে হবে না। পরিবহন খরচ এবং ঝুঁকি দুটোই কমে যাবে।
লঞ্চযাত্রী ঢালচরের বাসিন্দা শরিফ ও শাহে আলম জানান, বঙ্গোপসাগরের কাছাকাছি বসবাস করি। একসময়ে আমাদের ঢালচর থেকে মাত্র একটি লঞ্চ চলাচল করতো। ৫ আগষ্টের পর ঢালচর ইউনিয়ন বাসীর জন্য বিআইডব্লিউটিএ থেকে রুটপারমিট নিয়ে আরও একটি লঞ্চ সার্ভিস চালু করেছেন স্থানীয়রা। এরফলে তারুয়া সমুদ্র সৈকতে ঘুরতে আসা পর্যটক, ঢালচরের ব্যবসায়ী ও কর্মজীবী মানুষের দুর্ভোগ কমেছে। অন্যদিকে সাগর থেকে মৎস্যজীবিদের আহরিত মাছ চরফ্যাশন সহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো সম্ভব হবে। এতে মৎস্য ব্যবসায়ীদের খরচ কম হবে এবং তারা দামও বেশি পাবেন। অন্যদিকে ঢালচরের পর্যটন খাতে এক নতুন দিগন্তের সূচনা সূষ্টি হবে।
চরপাতিলার লঞ্চযাত্রী রহিমা বিবি ও ইউসুফ জানান, চরপাতিলা ২ টি ওয়ার্ডে ৫ হাজারেরও বেশি মানুষ বসবাস করছে। বর্ষা মৌসমে এই অঞ্চলের মানুষের দুর্ভোগের শেষ নাই। মানুষ অসুস্থ হলে দ্রুততম সময়ের মধ্যে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া সম্ভব হয়না। চরের মানুষের চলাচলের এক মাত্র মাধ্যম ছিলো নৌকা বা ট্রলার। কোনদিন এইসব ট্রলার  চলতো আবার কোনদিন চলতো না। বর্তমানে আরও একটি ট্রলার যুক্ত হয়েছে। এতে মানুষের কিছুটা দুর্ভোগ কমেছে এবং ব্যবসায়ীদের ব্যবসায়ীক পণ্য ঝুঁকিমুক্তভাবে সহজেই চরকচ্ছপিয়া থেকে চরপাতিলায় আনতে পারেন। লঞ্চ সার্ভিসগুলো চালু থাকলে এই অঞ্চলের অর্থনীতিতে গতি ফিরে আসবে বলে মনে করেন তারা।

ঢালচর এমএল লঞ্চ চালক মো. সোহাগ বলেন, ৫ আগষ্টের আগে ঢালচর লাইনে একটি লঞ্চ চলাচল করতো। এতে পর্যটক , ব্যবসায়ী ও কর্মজীবি মানুষের দুর্ভোগের শেষ ছিলো না। মানুষের দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে চরকুকরির বাসিন্ধা সবুজ হাওলাদার আরো একটি লঞ্চ সার্ভিস চালু করেছেন। আমি এই লঞ্চের চালক । আমার লঞ্চটি প্রতিদিন দুপুর ১ টার সময়ে চরকচ্ছপিয়া লঞ্চঘাট থেকে ছেড়ে ঢালচর উদ্দেশ্যে গিয়ে ৩ টায় পৌছায়। আমরা যাত্রীদের কাছ থেকে জনপ্রতি ১২০ টাকা ভাড়া নেই।

চরকুকরি রুটে চলাচলকারী এমএল সুপ্তি লঞ্চের চালক আলআমিন বলেন, চরকচ্ছপিয়া ঘাট থেকে ছেড়ে গিয়ে বেলা ১২ টায় গিয়ে চরকুকরি লঞ্চঘাটে ভিড়বে। আবার দুপুর ১ টার দিকে চরকচ্ছপিয়ার উদ্দেশে ছেড়ে আসবো। যাত্রীর  কাছ থেকে জনপ্রতি ৭০ টাকা ভাড়া নেই।
স্পীডবোড ড্রাইভার সুমন জানান, চরকচ্ছপিয়া লঞ্চঘাটে ১০ টি স্পীড বোড রয়েছে। সবসময়ে চলে না। দেখা গেছে যাত্রী হলে স্প্রীডবোড চালানো হয়। তখন ঢালচর যেতে চাইলে যাত্রীদের কাছ জনপ্রতি ৩০০ টাকা, চরকুকরি ও চরপাতিলা জনপ্রতি ২০০ টাকা, এবং চরমন্তাজে জনপ্রতি ২৫০ টাকা ভাড়া নেয়া হয়। এছাড়া চরপাতিলার লঞ্চ ভাড়া ৫০ টাকা, চরমন্তাজের লঞ্চভাড়া ১৪০ টাকা।
চরকুকরির এমভি সাবরিয়ান ও এমএল ফাহিম তুষার লঞ্চ মালিক মো.সবুজ হাওলাদার বলেন, ঢালচর, চরপাতিলা, ও চরকুকরি-মুকরি দ্বীপের মানুষের দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে এই রুটে নতুন দুইটি লঞ্চ সার্ভিস চালু করা হয়েছে। এবং চরকচ্ছপিয়া লঞ্চঘাটে যাত্রীদের লঞ্চে ওঠানামা করতে কষ্ট হওয়ায় দক্ষিণ আইচা থানা বিএনপির সাধারন সম্পাদক ফারুক মাষ্টার বিআইডব্লিউটিএ’র ভোলা কর্মকর্তা বরাবর অবেদন করলে কর্তৃপক্ষ গত ২২ এপ্রিল একটি পল্টন দেন।
দক্ষিণ আইচা থানা বিএনপির সাধারন সম্পাদক মো. ফারুক মাষ্টার বলেন, যাতায়াতে দুর্ভোগের কারনে পর্যটক চরকুকরি-মুকরি, ঢালচরের তারুয়া সৈকত ঘুরতে আসতো না। এবং ব্যবসায়ী ও কর্মজীবী মানুষেরা লঞ্চের অপেক্ষায় ঘন্টার পর ঘন্টা চরকচ্ছপিয়া লঞ্চঘাটে বসে থাকতেন। পর্যটন খাতে পর্যটক ফেরাতে স্থানীয়রা আরো ৫ টি লঞ্চ সার্ভিস চালু করেছেন। বর্তমানে চরকচ্ছপিয়া লঞ্চঘাট থেকে ৯ লঞ্চ চলাচল করছে। এই লঞ্চ সার্ভিসগুলো টিকিয়ে রাখতে সবার সহযোগীতা চেয়েছেন তিনি।
দক্ষিণ আইচা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) এরশাদুল হক ভুইয়া জানান, চরকচ্ছপিয়া থেকে ৪ টি রুটে ৯ টি লঞ্চ চলাচল করছে। যাত্রীরা যাতে হয়রানী না হয় পুলিশের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেয়া হবে।


এএইচ/এমআর

বাংলাদেশ সময়: ২১:০২:২২ ● ৬ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ