চাটার্ড বিমানে করে জীবনের শেষ ইচ্ছে পূরণে সিঙ্গাপুর থেকে সন্তানের কাছে ফিরল বাবা

প্রথম পাতা » লিড নিউজ » চাটার্ড বিমানে করে জীবনের শেষ ইচ্ছে পূরণে সিঙ্গাপুর থেকে সন্তানের কাছে ফিরল বাবা
শুক্রবার ● ২৯ মে ২০২০


---

মহিববুল্লাহ মুহিব॥
একজন প্রবাসী বাংলাদেশীর জন্য মানবিকতার অনন্য এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন সিঙ্গাপুরের চিকিৎসকরা। করোনার লকডাউনে বিশ্বব্যাপী যখন বিমান যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন, পাকস্থলীর ক্যান্সারে আক্রান্ত বাংলাদেশী এই শ্রমিকের জন্য প্রায় ৫৫লাখ টাকার তহবিল গঠন করে চার্টার্ড বিমানে তাকে দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছেন সিঙ্গাপুরের একদল চিকিৎসক। দুরারোগ্য ক্যান্সারে মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও জীবনের বাকিটা সময় সন্তানের কাছে কাটানোর প্রবল ইচ্ছে পূরণে সীমাহীন আনন্দে ভাসছেন এখন বাবা রানা সিকদার।
২০০৭ সালে জীবন ও জীবিকার তাগিদে সিঙ্গাপুরে পারি জমান বাংলাদেশী শ্রমিক সিকদার রানা। ২০১৫ সালে দেশে ফিরে সিদ্ধান্ত নেন আর বিদেশ না যাবার। জীবনের সকল সঞ্চয় দিয়ে শুরু করেন নারায়নগঞ্জের নিজ এলাকায় ব্যবসা। কিন্তু সেই ব্যবসায় লাভের মুখ দেখেননি সিকদার রানা। উল্টো খুইয়েছেন সকল সঞ্চয়। সিদ্ধান্ত নেন আবারো প্রবাসে যাবার। সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশী একজনের মালিকানাধিন কোম্পানি ইউএনআই মেরিন সার্ভিস লিমিটেড এর শীপ ইয়ার্ডে শ্রমিকের ভিসায় আবারো গমন করেন এক বছর আগে। ২০২০ সালের মার্চ মাসের শেষের দিকে শীপ ইয়ার্ডে কর্মরত অবস্থায় প্রচন্ড পেটে ব্যাথা অনুভূত হয় সিকদার রানার। তাকে দ্রুত ভর্তি করা হয় সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর পাকস্থলিতে ক্যান্সার ধরা পড়ে তার। ক্যান্সার পুরো পেটে এমনভাবে ছড়িয়েছে যে, চিকিৎসা দিতে গিয়ে শত চেষ্টায়ও বিফল ডাক্তাররা। মুখ দিয়ে পেটে আর খাবার যাচ্ছে না রানার। পেটে বিসিসি করে পাইপের মধ্যে থেকে খাবার ঢুকিয়ে কোনোভাবে বাঁচিয়ে রাখা হয় তাকে। সব চেষ্টা ব্যার্থ জেনে রানাকে ভর্তি করা হয় সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ক্যান্সার সেন্টারের প্যালিয়েটিভ কেয়ারে। কিন্তু দেশে ফেরার ব্যাকুলতা বাড়তে থাকে রানার। রানা ততদিনে জেনে গেছেনন, তার হাতে আর সময় নেই। মৃত্যু এখন কড়া নাড়ছে সিকদার রানার জীবনের দরজায়। একমাত্র সন্তান মাহিমকে দেখার ব্যাকুলতা রানার শরীরের যন্ত্রণাকে যেন আরো বাড়িয়ে তুলেছিল। রানা তার জীবনের শেষ কটা দিন পরিবারের সাথে কাটাবার প্রবল ইচ্ছের কথা জানান সেখানকার চিকিৎসকদের।
রানার এ ইচ্ছাশক্তি আর ভালোবাসার ব্যাকুলতা দেখে মন ভিজে যায় সিঙ্গাপুরের হাসপাতালের ডাক্তারদের । এরপর নিজেরা ফান্ড গঠনের উদ্যোগ নেন চিকিৎসকরা, সফলও হন। অবশেষে একটি চাটার্ড বিমানে করে সিকদার রানাকে পৌঁছে দেন বাংলাদেশে। তার সাথে আসেন হাসপাতালটির দু’জন ডাক্তারও । রানার চিকিৎসার পুরো বিষয়টি দেড় মাস ধরে তদারকি করছেন সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ক্যান্সার সেন্টারের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. সিনথিয়া গো। তিনি জানান, সিকদার রানার জীবনের শেষ ইচ্ছে পুরণের জন্য বন্ধু, সহকর্মী, এনজিও প্রতিনিধিদের সাথে আলাপ করেছেন তিনি। সবাই এগিয়ে আসায় রানা সিকদারকে তার সন্তানের কাছে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছেন তারা।
রানা সিকদারের চিকিৎসা করতে গিয়ে প্রায় ৮০হাজার ডলার খরচ করেছে তার কোম্পানি ইউএনআই মেরিন সার্ভিস লিমিটেড।
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে রানাকে নিয়ে যাওয়া হয় বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যালিয়েটিভ কেয়ারে। একমাস ধরে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ, ভরসা কেবল স্যালাইন। হাসপাতালে রেখে বিশেষ কোন চিকিৎসা দেয়াও সম্ভব নয় রানার। তাই জীবনের বাকি দিনগুলো নিজের বাড়িতেই ছেলের সাথে কাটানোর আগ্রহের কথা চিকিৎসকদের জানান এই মৃত্যুপথযাত্রী।
রানাকে গ্রহণ করতে আসেন তার স্ত্রী মৌসুমী এবং ভাই মাসুম। করোনা পরিস্থিতিতে রানার ছেলে মাহিমকে সঙ্গে আনতে পারেননি তারা। কিন্তু সন্তানকে দেখার ব্যাকুলতা বিএসএমএমইউতেও বেশিক্ষণ থাকতে দেয়নি রানাকে। ওই দিনই এম্বুলেন্সে করে নিয়ে যাওয়া হয় তার গ্রামের বাড়ি নারায়নগঞ্জে।
সন্তানের জন্য প্রবাসী বাংলাদেশী রানার ভালোবাসায় সাড়া দিয়ে সিঙ্গাপুরের চিকিৎসকদের এই মহতী উদ্যোগের প্রশংসায় পঞ্চমুখ এখন অনেকেই।

বাংলাদেশ সময়: ২৩:৪৭:১২ ● ৪৩৩ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ