কুয়াকাটার আলীপুরে রোহিঙ্গাদের অবস্থান ক্রমশ বাড়ছে: শণাক্ত হয়েছে ৭২ পরিবার

প্রথম পাতা » লিড নিউজ » কুয়াকাটার আলীপুরে রোহিঙ্গাদের অবস্থান ক্রমশ বাড়ছে: শণাক্ত হয়েছে ৭২ পরিবার
শনিবার ● ৪ জানুয়ারী ২০২০


প্রতীকী ছবি

 

মেজবাহউদ্দিন মাননু, সাগরকন্যা প্রতিবেদন ॥

কলাপাড়ার উপকূলীয় মহিপুর-আলীপুরে রোহিঙ্গাদের অবস্থান ক্রমশ বাড়ছে। এরা কৌশলে ২০১৭ সালের জুলাই মাসে হালনাগাদ ভোটার তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হয়েছেন। চিহ্নিত মৎস্যব্যবসায়ী ও ট্রলার মালিকরা এসব কাজে প্রচ্ছন্ন সহায়তাসহ মদদ দিয়েছেন। ফলে এসব রোহিঙ্গারা এখন এখানকার স্থায়ী বাসিন্দা বনে গেছেন। ৭২টি রোহিঙ্গা পরিবার এখন মৎস্যবন্দর আলীপুর বসবাস করছে। এরা অপরাধপ্রবণ কাজসহ মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িতের অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। এরা এখন নতুন নতুন রোহিঙ্গাসহ অপরাধির আশ্রয়স্থল বলেও জনশ্রুতি রয়েছে। খবর নির্ভরযোগ্য সূত্রের।

 

সূত্রমতে, মায়ানমার থেকে নাফ নদী হয়ে কক্সবাজারে পাচার হওয়া ইয়াবাসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক এসব রোহিঙ্গাসহ তাদের সহযোগীদের মাধ্যমে ট্রলারযোগে নৌরুটে কলাপাড়ায় আসছে। চলে যাচ্ছে বিভিন্ন রুটে। বর্তমানে নদীপথ মাদকের সবচেয়ে নিরাপদ পথ হিসেবে এরা বেছে নিয়েছে। বিভিন্ন সময় মাদকের চালান পুলিশের হাতে আটকও হয়েছে। ২০১৭ সালে মহিপুর থানা পুলিশ মৎস্য বন্দর আলীপুর থেকে ৩৯৫০ পিস ইয়াবাসহ ফাতেমা নামের এক রোহিঙ্গা নারীকে আটক করে। যার সঙ্গে জড়িত রয়েছে এক জেলে। পুরুষ রোহিঙ্গারা জেলে পরিচয়ে ট্রলারে মাছ শিকারের পাশাপাশি গভীর সাগরে জলদস্যুদের সঙ্গে জেলে অপহরণ বাণিজ্যের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত রয়েছে বলে জেলেরা জানায়। ২০১৭ সালে একটি ট্রলারে জেলে সেজে শাহাবুদ্দিন নামের এক রোহিঙ্গা সাগরে মাছ শিকারে গেলে ওই ট্রলারে জলদস্যুরা হামলা চালায়। মারধর করে টাকা-পয়সা মাছ লুটে নেয়। জলদস্যুরা শাহবুদ্দিনকে তাদের ট্রলারে তুলে নেয়। এরপর আর তার খোঁজ মেলেনি। দিনদিন এদের অবস্থান আরও বাড়ছে বলে স্থানীয় সাধারণ জেলেরা জানায়। সরকারিভাবে কলাপাড়ার আলীপুরে এবং মহিপুরে ৭২ টি রোহিঙ্গা পরিবার শণাক্ত করা হয়েছে।

 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রায় দুই যুগ আগে আসা রোহিঙ্গা মাকাছি মাঝি এখন কাসেম মাঝি নামে আলীপুরে পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করছেন। এখনও তিনি পরিবার-পরিজন নিয়ে ভাড়া বাসাতেই থাকেন। বিদ্যুত পানির সুবিধা না থাকা একটি ছোট্ট ঘরে এক হাজার টাকা মাসিক ভাড়ায় সেখানে তিনি থাকছেন। তার স্ত্রী ষাটোর্ধ রোজিনা জানান, স্থানীয় প্রভাবশালী এক ট্রলার মালিকের ভাড়া ঘরে থাকেন। প্রশাসনিক সকল ঝামেলা তিনি সামলে নেবেন তাই কাসেম অন্য কোন বাড়িতে যাচ্ছেন না।

জানা গেছে, অপেক্ষাকৃত কম মজুরিতে জেলে হিসেবে খাটানো যায়। মাদকসহ বিভিন্ন অপকর্মে ব্যবহৃত করতে এরা নিরাপদ বলেই চিহ্নিত স্থানীয় মহল রোহিঙ্গাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে। এ নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের অসন্তোষ থাকলেও জনপ্রতিনিধি ও ট্রলার মালিকরা প্রভাবশালী হওয়ায় প্রকাশ্যে মুখ খোলার সাহস পায়না কেউ।

 

প্রায় দশ বছর আগে আলীপুরে এসে বসবাস করছে রোহিঙ্গা সৈয়দ (৪০)। তিনি জানায়, তারা এখানে আসেননি। আনা হয়েছে। আলীপুরের এক প্রভাবশালী মৎস্য ব্যবসায়ী ও ট্রলার মালিক তাদের কক্সবাজর থেকে এনেছেন। সৈয়দ আরও জানায়, তারা এক যুগ আগে মায়ানমার থেকে নাফনদী পাড়ি দিয়ে কক্সবাজারের টেকনাফে আশ্রায় নেয়। সেখান থেকে ওই ট্রলার মালিকের লোক গিয়ে তাদের পরিবারসহ আলীপুরে নিয়ে এসেছেন। তার মতো অনেকেই এখন আলীপুরের স্থানীয় বাসিন্দা। সৈয়দ বর্তমানে ওই ট্রলার মালিকের ভাড়া বাসায় থাকেন। রোহিঙ্গাদের এখানে অলিখিত সমিতি রয়েছে। যার নেতা হিসাবে শামসু রোহিঙ্গাকে সবাই চেনেন।

 

সূত্র জানায়, মায়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন স্থানে প্রথমে আস্তানা নেয়। পরে দেশের বিভিন্ন স্থানের মতো আলীপুর-মহিপুরে আশ্রয় নেয়। অভাবের কারণে এদেরকে কম মজুরিতে ট্রলারে খাটানো যায়। এছাড়া মাদকসহ বিভিন্ন ব্যবসায় লাগানোর সুযোগ রয়েছে। এরা অনেকে আবার জড়িয়ে পড়ছে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে। ২০১৪-২০১৫সালের দিকে আলীপুরের রোহিঙ্গা ফজইল্যা বাহিনী প্রকাশ্যে বহুবার সশস্ত্র মহড়া দেয়। চালায় প্রতিপক্ষের ওপর সশস্ত্র হামলা। ফজলের ভাই করিম ছিল মুর্তিমাণ আতঙ্ক। এখন করিম মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছে এবং ফজল নিরুদ্দেশ বলে জেলেরা জানায়। রোহিঙ্গা আনাগোনা এখনও বহাল রয়েছে যার প্রমাণ মেলে বছরখানেক আগে ফেব্রুয়ারি মাসে বাইচু (১) ও বাইচু (২) ট্রলারে জলদস্যুরা হানা দেয়ার ঘটনায়। তখন ট্রলার থেকে মাছ, জাল, জ¦ালানি, মোবাইলসহ টাকা-পয়সা নিয়ে গেছে। তারা ট্রলার দুটির ইঞ্জিন বিকল করে দিয়ে যায়। এসময় ট্রলারে থাকা রোহিঙ্গা শাহবুদ্দিন নামের এক জেলেকে মুক্তিপণের দাবিতে অপহরন করে নিয়ে যায়। ২০১৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারি এ ঘটনা ঘটে। কিন্তু আজ অবধি এ শাহবুদ্দিনকে ফিরিয়ে দেয়ার কথা বলে জলদস্যুর ওই দলটির কেউ ট্রলার মাঝি নুর-আলম, দেলোয়ার কিংবা মালিক বেল্লাল হোসেনকে মোবাইল করেনি।

 

মাঝি দেলোয়ার জানান, এই প্রথমবারে তাদের ট্রলারে শাহবুদ্দিনকে তারা সাধারণ জেলে শ্রমিক হিসেবে নিয়েছিল। তার সম্পর্কে আর কিছুই জানেন না। তবে শাহবুদ্দিন নিজেকে রোহিঙ্গা হিসেবে পরিচয় দিয়েছে। সাধারণ জেলেদের দাবি সম্প্রতি মায়ানমার থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করা রোহিঙ্গাদের একজন এই শাহবুদ্দিন হতে পারে। এরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে সাধারণ মানুষের ভিড়ে মিশে যাচ্ছে। এরা কেউ আবার জলদস্যুসহ বিভিন্ন অপরাধীদের সহযোগী হয়ে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে কাজ করছে। এরা যে কোন সময় বড় ধরনের নাশকতা ঘটাতে পারে। এছাড়া স্থানীয়দের এন্তার অভিযোগ বর্তমানে কলাপাড়ায় বসবাসরত রোহিঙ্গাদের একটি চিহ্নিত চক্র মাদকসহ বিভিন্ন অপরাধপ্রবণ কাজের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত রয়েছে। কলাপাড়ায় সরকারিভাবে পরিসংখ্যান অফিসের হিসেবে চিহ্নিত রোহিঙ্গা পরিবারের সংখ্যা ৭২টি থাকলেও বাস্তবে এর সংখ্য বেশি বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

 

২০১৭ সালের ১৭ জুলাই নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিব মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ্ নির্বাচন ভবনে তার কার্যালয়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদ নিয়ে সমন্বয় কমিটির একটি সভা করেন। ওই সভায় ভোটার তালিকায় রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভুক্তি ঠেকাতে বিশেষ এলাকার পরিধি বাড়ানো হয়েছে। সেক্ষেত্রে বৃহত্তর চট্টগ্রাম এলাকায় ভোটার হতে নাগরিদের অধিকতর তথ্য দাখিল করার নির্দেশ দেয়। এসব এলাকায় কেউ ভোটার হতে চাইলে বাবা-মার এনআইডি, ফুফু-চাচার এনআইডি, প্রয়োজনে অন্য আত্মীয়ের এনআইডির প্রমাণ হিসেবে দিতে হবে। কিন্তু এখানকার অধিকাংশ রোহিঙ্গা এনআইডি কার্ড আগেই পেয়েছেন। হয়েছেন ভোটার তালিকায় অন্তর্ভূক্ত। ফলে হালনাগাদ ভোটার তালিকায় নতুন রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভুক্তি ঠেকানো যায়নি। এছাড়া ২০টি উপজেলায় রোহিঙ্গা উপস্থিতি ধরে নিয়ে ২০টি কমিটি কাজ করলেও তখন উপজেলার সংখ্যা আরও দশটি বাড়িয়েছে নির্বাচন কমিশন। রোহিঙ্গা উপস্থিতির ৩০টি উপজেলার মধ্যে কলাপাড়া উপজেলা ছিল না। ফলে রোহিঙ্গারা নিরাপদে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। বুধবার বিকেলে কলাপাড়ায় উপজেলা টাস্কফোর্স কমিটির সভায় এনিয়ে উপস্থিত জনপ্রতিনিধিসহ সদস্যরা আলোচনা করেছেন।

 

কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও এ কমিটির সভাপতি মো. মুনিবুর রহমান জানান, অবৈধ অনুপ্রবেশকারী মিয়ানমার নাগরিকদের (রোহিঙ্গা) চিহ্নিতকরণ এবং যেন বসতি স্থাপন করতে না পারে এ জন্য সরকারের কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। যা বাস্তবায়নে আজকের এই সভা। তিনি এ বিষয় সচেষ্ট রয়েছেন।


এমইউএম/কেএস 

 

বাংলাদেশ সময়: ১৯:০৩:৩১ ● ১৪৪৯ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ