
সাগরকন্যা প্রতিবেদক, পটুয়াখালী
টেকসই স্থায়ী বেরিবাঁধ, পর্যাপ্ত সাইক্লোন সেল্টারের অভাব, আপতকালীন উদ্বার ব্যবস্থার দুর্বলতায় এখনো ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছাসে প্রান ও সম্পদহানির আতঙ্ক কাটেনি পটুয়াখালীর উপকূলীয় জনপদের প্রায় লক্ষাধিক মানুষের। দূর্যোগের এ সমূহ ক্ষতি থেকে জীবন ও সম্পদ রক্ষার এখনও অনেক জনপদে তৈরি হয়নি সচেতনতা। এখনো তৈরি হয়নি ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছাসের ক্ষতির পরে সুরক্ষা বেস্টনীর নিশ্চয়তা। ফলে সরকারি-বেসরকারি সীমিত নানা উদ্যোগ থাকলেও ঘূর্ণিঝড় থেকে উপকূলবাসীর নিরাপত্তা আজও রয়েছে অরক্ষিত।
এপ্রিল-মে মাসে সমুদ্রের তাপমাত্রার আধিক্য ও আর্দ্রতা বেশি থাকায় বর্ষাকালের শুরুতে এবং অক্টোবর-নভেম্বর মাসে বর্ষার শেষে বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়। পৃথিবীতে তাপের ভারসাম্য রক্ষার এ স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার ফলে সৃস্ট এসব ঘূর্ণিঝড় উপকূলে আঘাত হানলে সৃস্টি হয় দুর্যোগের। উপকূলীয় জনপদে আঘাত হানা প্রতিটি বড়-মাঝারি-ছোট ঘূর্ণিঝড়ই কেড়ে নেয় মানুষের জীবন ও সম্পদ।
ঘূর্নিঝড়ের দূর্যোগ থেকে উপকূলের মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষায় তৈরি করা হয়েছে সাইক্লোন সেল্টার, বেরিবাঁধ। জেলায় ৭০৩টি সাইক্লোন সেল্টার, ৩৫টি মুজিব কিল্লা রয়েছে। কিন্তু ঝুঁকিতে থাকা মানুষের সংখ্যার বিপরীতে সাইক্লোন সেল্টার এখনো অপ্রতুল। এখনো অনেক চরাঞ্চলে তৈরি হয়নি সাইক্লোন সেল্টার। বিদ্যমান এসব সাইক্লোন সেল্টার ব্যবহারেও রয়েছে নানা সমস্যা। অধিকাংশ সাইক্লোস সেল্টারের যাতায়ত পথ কাঁচা। দুর্যোগকালীন সময়ে বর্ষায় এসব পথ হয়ে পড়ে কর্দমাক্ত। যা শিশু, বৃদ্ধ এবং অসুস্থ মানুষের চলাচলের জন্য অনুপযোগী হয়ে পড়ে। অনেক সাইক্লোন সেল্টারে নেই আলোর ব্যবস্থা, পানির ব্যবস্থা, গবাদি পশুসহ গৃহপালিত প্রানীর আশ্রয় ও সংরক্ষন ব্যবস্থা।
দুর্যোগের ক্ষতি থেকে দেশের উপকূল সুরক্ষায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের ১২৩টি পোল্ডারের অধীনে পাঁচ হাজার ১০৭ কিলোমিটার বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ রয়েছে। যারমধ্যে ৯৫৭ কিলোমিটার বাঁধ হচ্ছে সমুদ্র-তীরবর্তী। ৬০’র দশকে তৈরি এসব বেরিবাঁধ দীর্ঘ বছরে সংস্কার না হওয়ায় দূর্যোগ প্রতিরোধে হয়ে পড়েছে অকার্যকর। অনেক এলাকার বেরিবাঁধের উচ্চতা কমে যাওয়ায় বর্ষা মৌসুমে উচ্চ জোয়ারের পানি বাঁধ টপকে লোকালয়ে প্রবেশ করে। দুর্যোগেকালীন সময়ে এসব বাঁধ হয়ে পড়ে চরম আতঙ্কের।
পটুয়াখালীতে ৩৬টি পোল্ডারে অধীনে ১ হাজার ৮’শ ১৮ কিলোমিটার বেরিবাঁধ রয়েছে। উপকূলীয় ঝুঁকিপূর্ন উপজেলা কলাপাড়া, রাঙ্গাবালীতেই রয়েছে ৫১৮ কিলোমিটার বেরিবাঁধ। পানি উন্নয়ন বোর্ড পটুয়াখালী ও কলাপাড়া সার্কেলের ক্ষতিগ্রস্থ বেরিবাঁধ গুলোকে তিনটি ভাগে ভাগ করেছে। এরমধ্যে দুই সার্কেলে মোটামুটি ক্ষতিগ্রস্থ বেরিবাঁধ ১০ কিলোমিটার। অতি ঝুঁকিপূর্ণ বেরিবাঁধ ১৮ কিলোমিটার। আংশিক ঝুঁকিপূর্ণ বেরিবাঁধ রয়েছে ৩৪ কিলোমিটার। এরমধ্যে পটুয়াখালী সার্কেলে ১০ কিলোমিটার এবং কলাপাড়া সার্কেলে ৮ কিলোমিটার অতি ঝুঁকিপূর্ন এবং পটুয়াখালী সার্কেলে ১৯ কিলোমিটার এবং কলাপাড়া সার্কেলে ১৫ কিলোমিটার আশিংক ঝুঁকিপূর্ন বেরিবাঁধ রয়েছে।
বেরিবাঁধ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বরের সিডরে। এসময় উপকূলীয় অঞ্চলের দুই হাজার তিন’শ ৪১ কিলোমিটার বাঁধ আংশিক ও সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এরমধ্যে বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, ঝালকাঠি, বরিশাল, পিরোজপুর জেলার প্রায় ১’শ ৮০ কিলোমিটার সম্পূর্ণ এবং এক হাজার ৪’শ কিলোমিটার বাঁধ আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ক্ষতিগ্রস্থ এসব বাঁধ এখনো টেকসই ও স্থায়ীভাবে মেরামত করা হয়নি। ফলে দূর্যোগ ঝুঁকি নিয়েই কাটছে উপকূলবাসীর জীবন। ক্ষতিগ্রস্থ এসব বাঁধের দীর্ঘকালীন যন্ত্রনা একনো বয়ে বেড়াতে হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষদের।
দুর্যোগকালীন সময়ে স্বেচ্ছাসেবী সাহায্যকর্মী হিসাবে ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচীর আওতায় ৮ হাজার ৭শ’ ৬০ জন সিপিসি কর্মী রয়েছে। দুর্যোগের তথ্য প্রচারসহ সচেতনতা তৈরিতে এরা গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করে। কিন্তু দূর্যোগ শুরুর পূর্ব মুহুর্ত কিংবা দূর্যোগ চলাকালীন সময়ে দুর্গত মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে আনা, উদ্বারে নেই কোন ধরনের আধুনিক ব্যবস্থা। দূর্যোগ পরবর্তী সময়ে ক্ষতিগ্রস্থদের উদ্বার, সহায়তায়ও রয়েছে উচ্চ ঘাটতি।
আবহাওয়া অফিসের তথ্যে জানা যায়, ১৯৬০ সাল থেকে দেশের উপকূলে ৩৭টি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। এরমধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য হল ‘বিজলি’, ‘মোরা’, ‘রোয়ানু’, ‘মিধিলি’, ‘মোখা’, ‘আম্ফান’, ‘ফনি’, ‘সিত্রাং’ ‘বুলবুল’ ‘রিমাল’ ‘আইলা’ ‘আকাশ’, ‘নার্গিস’ ‘লায়লা’, ‘মহাসেন’ ’দি গ্রেট ভোলা’ ’উরির চর’ ‘কোমেন’। তবে এখনো মানুষের মনে দাগ কেটে আছে ১৯৯১ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়, ২০০৭ সালের সুপার সাইক্লোন ‘সিডর’, ২০০৯ সালের ‘আইলা’ ১৯৭০ সালের ভোলার ঘূর্ণিঝড়, ১৯৬০ সালের ১১ অক্টোবর ও ৩১শে অক্টোবর, ১৯৬৬ সালের ১ অক্টোবরের প্রবল ঘূর্ণিঝড় তান্ডব।
তথ্য বিশ্লেষনে দেখা যায়, ১৯৭০ সালের প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে ৫ লাখের বেশি মানুষ নিহত হয়। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল চট্টগ্রাম বিভাগের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয় প্রলয়ঙ্করী ঝড়ে ২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছাসে প্লবিত হয় সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চল। এতে ১ লাখ ৩৮ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে। প্রায় ১০ লক্ষ বসতবাড়ি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। প্রায় ১ কোটি মানুষ হয়ে যায় নি:স্ব। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বরে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে আঘাত হানে স্মরণকালের ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় সিডর। এতে ক্ষতিগ্রস্থ হয় ৩০ জেলার দুই শতাধিক উপজেলা। ১২-১৫ ফুট উচু জলোচ্ছাসে সরকারি হিসাবে ৩৩৬৬ জন প্রান হারানোর তথ্য উত্থাপন করলেও। বেসরকারি হিসাবে প্রায় দশ হাজার মানুষ প্রান হারায়। পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায় ৬ লাখ মানুষের বসতবাড়ি। মানুষ হয়ে পড়ে জীবিকাহীন।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষন করলে দেখা যায় ১৯৬০ সাল থেকে দেশের উপকূলে আঘাত হানা প্রতিটি ঘূর্ণিঝড় সংগঠিত হয়েছে এপ্রিল-মে এবং অক্টোবর-নভেম্বর মাসে। ১৯৬১ সালের ৯ মে ও ৩০ মে, ১৯৬৩ সালের ১৮ মে, ১৯৬৫ সালের ১১ মে, ৫ নভেম্বর ও ১৫ ডিসেম্বর, ১৯৬৬ সালের ১ নভেম্বর, ১৯৭০ সালের ২৩ অক্টোবর, ১৯৭৪ সালের ২৮ নভেম্বর, ১৯৮৩ সালের ১৫ অক্টোবর ও ৯ নভেম্বর, ১৯৮৮ সালের ২৯ নভেম্বর, ১৯৯০ সালের ১৮ ডিসেম্বর, ১৯৯৪ সালের ২ মে, ১৯৯৫ সালের ২৫ নভেম্বর, ১৯৯৭ সালের ১৯ মে ও ১৭ আগস্ট, ১৯৯৮ সালের ২০ মে, ২০০০ সালের ২৮ অক্টোবর, ২০০২ সালের ১২ নভেম্বর ও ২০০৪ সালের ১৯ মে আঘাত হানে।
পাখিমারার বাসিন্দা প্রশান্তমন ভৌমিক, হেল্লাল, সুশীতল বলেন, দুর্যেগকালীন সময়ে সাইক্লোন সেল্টারে যাওয়ার কাঁচা রাস্তা কাদা হয়ে যায়। যা বৃদ্ধ, অসুস্থ, শিশু, নারীদের ব্যবহারে কস্টদায়ক। অনেক সাইক্লোন সেল্টারে নেই পানি ও আলোর ব্যবস্থা। তবে বৃদ্ধ ও অসুস্থ রোগীদের সাইক্লোন সেল্টারের আনার জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রানালয়ের পরিবহন ব্যবস্থা রাখার অনুরোধ জানান তারা।
ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচীর মহিপুর ইউনিট টিম লিডার মিজানুর রহমান বুলেট ও মনিরুল ইসলাম বলেন, সাইক্লোন সেল্টারের যাতায়ত পথ এবং বাসতবাড়িসহ সম্পদ চুরির ভয়ে অনেকেই আশ্রয় কেন্দ্রে যেতে চায়না। দূর্যোগ চলাকালীন সময়ে বিপদগ্রস্থ এসব মানুষকে উদ্বারেও নেই কোন ব্যবস্থা।
কলাপাড়া উপজেলা ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচী সহকারী পরিচালক আসাদ-উজ্জামান খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, দুর্যোগকালীন সময়ে সাইক্লোন সেল্টারে আশ্রয় নেয়ার ক্ষেত্রে যেসব সমস্যা বিদ্যমান রয়েছে, তা নিরসনে দ্রুত উদ্যোগ গ্রহন করা হচ্ছে। সাইক্লোন সেল্টারের যাতায়তের অনেক পথ এখনো কাচাঁ। গ্রামীন অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় এসব রাস্তা পাকাঁ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। অধিকাংশ সাইক্লোন সেল্টারে সোলার সিস্টেম ব্যবহার করা হয়। কিছু সোলার দীর্ঘদিন ব্যবহারে খারাব হতে পারে। দুর্যোগ মন্ত্রনালয়ের মাধ্যমে তা নতুন বরাদ্ধ বা মেরামত করে দেয়া হবে।
জেআর/এমআর