
সাগর উপকূলের মানুষ প্রতি বছর ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সাথে সংগ্রাম করে বেঁচে আছে। কখনো কখনো প্রলয়ের মতো ভাসিয়ে নিয়ে যায় জীবন, বাড়িঘর, মাঠঘাট, স্বপ্ন। তারপর কিছুদিন মিডিয়ায় তোলপাড়, কাগজে-কলমে সভা-সেমিনার, কয়েক কিস্তি ত্রাণ- এরপর আবার সব আগের মতো। অথচ ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলা করতে হয় প্রতিবছর, ক্ষয়ক্ষতির চিত্রও জানা, দুর্যোগকালে কী করা উচিত- তাও জানা। তবু কেন একই দুর্যোগে বারবার ধ্বংস হয় আমাদের উপকূল?
পটুয়াখালীর উপকূলীয় অঞ্চলগুলোর চিত্র এখনো অশ্রুমাখা বাস্তবতায় ধরা দেয়। বেড়িবাঁধগুলো অনেক বছর ধরে সংস্কারহীন, দুর্বল ও অকার্যকর। সাইক্লোন সেল্টার অপ্রতুল, যেগুলো আছে সেগুলোর অধিকাংশই পানিবিহীন, আলোবিহীন, রাস্তাবিহীন। কোথাও কোথাও নারী, শিশু, বৃদ্ধ- এমনকি গবাদিপশুর আশ্রয়ের ব্যবস্থাও নেই। তাহলে উপকূলবাসী যাবে কোথায়?
সরকারি হিসাবে পটুয়াখালী জেলায় ৭০৩টি সাইক্লোন সেল্টার, ৩৫টি মুজিব কিল্লা থাকলেও কয়েক লাখ ঝুঁকিপূর্ণ মানুষের জন্য এটি পরিসংখ্যান মাত্র- বাস্তবে নিরাপত্তার নয়।
ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির হাজারো কর্মী থাকলেও ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে উদ্ধার কার্যক্রমের জন্য নেই আধুনিক সরঞ্জাম কিংবা সুনির্দিষ্ট পরিবহন ব্যবস্থা। অধিকাংশ সেল্টারের রাস্তাগুলো বর্ষায় কাদা মাখা হয়ে ওঠে, যা রোগী, শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য সংকটকালে বিপজ্জনক বলা যায়।
১৯৭০, ১৯৯১, ২০০৭- এই তিনটি বছর দেশের উপকূল ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। অসংখ্য প্রাণহানী ঘটেছে। সিডরের ১৭ বছর পরও আজও সেই আঘাতের ক্ষত শুকায়নি। টেকসই বেড়িবাঁধের প্রতিশ্রুতি সরকারের পক্ষ থেকে বারবার দেওয়া হলেও বাস্তবে তা থেকে গেছে ফাইলবন্দী। প্রশ্ন জাগে- দুর্যোগপীড়িত উপকূলের মানুষ কি কেবল প্রতিশ্রুতির বেড়াজালে আটকে থাকবে?
দায়িত্বহীনতার ঘূর্ণিপাকে আটকে আছে উপকূলের ভবিষ্যৎ:-
প্রশাসনের পরিকল্পনা প্রণয়ন থেকে শুরু করে বাস্তবায়ন পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে দীর্ঘসূত্রতা ও দায় এড়ানোর প্রবণতা স্পষ্ট। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সরকারের নিজস্ব দক্ষ রেসকিউ টিম, র্যাপিড রেসপন্স ইউনিট, প্রযুক্তিভিত্তিক সতর্কতামূলক ব্যবস্থা থাকা উচিত ছিল বহু আগেই।
তবে দোষারোপ নয়—আমরা চাই কার্যকর পদক্ষেপ। দুর্যোগ পূর্ব, দুর্যোগকালীন ও পরবর্তী তিন ধাপেই চাই সমন্বিত, বিজ্ঞানভিত্তিক, মানবিক এবং দ্রুতগতির ব্যবস্থা। ঘূর্ণিঝড় হলে মানুষ মরবেই- এই পুরনো ধারণা বদলাতে হবে। উন্নয়নের বুলি দিয়ে উপকূলবাসীর ক্ষত ঢেকে রাখা যাবে না।
আমাদের জোরালো প্রস্তাবনা:-
(০১) বেড়িবাঁধগুলো জরুরি ভিত্তিতে টেকসই করে পুনর্নির্মাণ ও সংস্কার করতে হবে। (০২) নতুন চরাঞ্চলে দ্রুত পর্যাপ্ত সাইক্লোন সেল্টার নির্মাণ এবং পুরাত সেল্টারগুলোকে আধুনিকায়ন করা। (০৩) সেল্টারগুলোর যোগাযোগব্যবস্থা পাকা করা, আলো-পানি-স্যানিটেশন ও পশু সুরক্ষার পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। (০৪) প্রতিটি ইউনিয়নে দুর্যোগকালীন উদ্ধার ইউনিট গঠন করতে হবে, যাদের প্রশিক্ষণ, সরঞ্জাম ও নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থা থাকবে। (০৫) উপকূলীয় এলাকায় দুর্যোগের সময় সম্পদের চুরি বন্ধে সেল্টার কেন্দ্রীক নিরাপত্তাব্যবস্থা থাকতে হবে।
মোটকথা ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস থামবে না এবং প্রকৃতিকেও থামানো যাবে না, কিন্তু মানুষকে নিরাপদ রাখা যাবে- যদি আমরা আন্তরিক হই। যদি দায় এড়িয়ে না গিয়ে কাজ করি, কেবল তবেই সম্ভব হবে।
উপকূল রক্ষা করা কেবল জাতীয় কর্তব্য নয়, এটি মানবিক দায়িত্ব।