মুক্তি পেলেন জাহালম, বিচার চান দুদকের

প্রথম পাতা » লিড নিউজ » মুক্তি পেলেন জাহালম, বিচার চান দুদকের
সোমবার ● ৪ ফেব্রুয়ারী ২০১৯


জাহালম
সাগরকন্যা ডেস্ক ॥
অপরাধী না হয়েও আসামি হয়ে ৩ বছর ধরে কারাগারে থাকার পর মুক্তি পেয়েছেন জাহালম। হাই কোর্টের আদেশের পর সোমবার প্রথম প্রহরে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে ছাড়া পান এই ব্যক্তি। কাশিমপুরের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার-২-এর তত্ত্বাবধায়ক সুব্রত কুমার বালা বলেন, রাত পৌনে ১টার দিকে তার মুক্তির আদেশের কাগজপত্র কারাগারে আসে। তা যাচাই-বাছাইয়ের শেষে কিছুণ পরই তাকে মুক্তি দেওয়া হয়।

মুক্তি পাওয়ার পর জাহালম কারাফটকে সাংবাদিকদের বলেন, তিনি বিনাবিচারের আটক থাকার তিপূরণ চান। বারবার নিজেকে নির্দোষ বলার পরও তাকে যারা কারাগারে ঢুকিয়েছে, তাদের শাস্তি চেয়েছেন তিনি। টাঙ্গাইলের এই পাটকল শ্রমিক তার চাকরিও ফেরত চেয়েছেন। কারাগার থেকে বেরিয়ে দুদকের বিরুদ্ধে ােভ প্রকাশ করে সাংবাদিকদের জাহালাম বলেন, কোনো অপরাধ না করেও দুদক আমাকে মিথ্যা মামলায় তিন বছর কারাগারে আটকে রেখেছে; আমি দুদকের কঠিন বিচার চাই। তাদের কারণে আমি জেলখানায় অনেক কষ্টে দিন কাটিয়েছি। কারাগারের ওয়ার্ডে সেবকের কাজকর্ম করেছি। এর আগে আমি দুদককে বলেছিলাম, আমি সালেক নই, আমি জাহালম। কিন্তু তারা তা বিশ্বাস করেনি।

জাহালম বলেন, আমি অনেক তিগস্ত হয়েছি। আমি এর তিপূরণ চাই। আমি চাকরি চাই। আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাদের বিচার চাই। আমাকে মুক্তি দেওয়ায় আদালতকে ধন্যবাদ জানাই। আমি ভাবতে পারিনি জীবনে কারামুক্ত হতে পারব। আজ মুক্তি পেয়ে আমার খুব ভাল লাগছে। দীর্ঘদিন পর জাহালমকে কাছে পেয়ে কাশিমপুর কারাফটকে তাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তার ভাই সাহানুর মিয়া। তিনিও আদালতকে ধন্যবাদ জানিয়ে এ ভুলের উপযুক্ত বিচার এবং তিপূরণ দাবি করেন। জাহালমকে দুদকের মামলায় গ্রেফতারের পর ২০১৬ সালের ১৭ মে ঢাকা থেকে কাশিমপুর কারাগারে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল।

দুদকের ভুলে কারাগারে থাকা জাহালমকে সোনালী ব্যাংকের অর্থ জালিয়াতির মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়ে গত রোববারই মুক্তি দিতে নির্দেশ দিয়েছিল হাই কোর্ট। বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কামরুল কাদেরের হাই কোর্ট বেঞ্চের রবিবার দেওয়া আদেশে বলা হয়েছিল, কোনো নির্দোষ ব্যক্তিকে এক মিনিটও কারাগারে রাখার পে আমরা না। এই ভুল তদন্তে কোনো সিন্ডিকেট জড়িত কি না, সিন্ডিকেট থাকলে কারা এর সঙ্গে জড়িত, তা চিহ্নিত করে আদালতকে জানাতে হবে। না হলে আদালত এ বিষয়ে হস্তপে করবে। এরকম ভুলের দায় দুদক কোনোভাবেই এড়াতে পারে না বলেও মন্তব্য করেছে আদালত। সোনালী ব্যাংকের প্রায় সাড়ে ১৮ কোটি টাকা জালিয়াতির অভিযোগে আবু সালেক নামের এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ৩৩টি মামলা করে দুদক। কিন্তু দুদকের ভুলে সালেকের বদলে তিন বছর ধরে কারাগারে কাটাতে হয় টাঙ্গাইলের জাহালমকে।

এ নিয়ে গত ৩০ জানুয়ারি প্রথম আলোয় ‘স্যার, আমি জাহালম, সালেক না’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটি সেদিন বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কামরুল কাদেরের হাই কোর্ট বেঞ্চের নজরে আনেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অমিত দাশ গুপ্ত। পরে আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করে। জাহালমের আটকাদেশ কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, জানতে চাওয়া হয় রুলে। সেই সঙ্গে ‘ভুল আসামির’ কারাগারে থাকার ব্যাখ্যা জানতে দুদক চেয়ারম্যানের প্রতিনিধি, মামলার বাদী দুদক কর্মকর্তা, স্বরাষ্ট্র সচিবের প্রতিনিধি ও আইন সচিবের প্রতিনিধিকে তলব করে হাই কোর্ট। সে অনুযায়ী দুদক চেয়ারম্যানের প্রতিনিধি হিসেবে দুদকের মহাপরিচালক (তদন্ত) মোস্তাফিজুর রহমান, মামলার বাদী আব্দুল্লাহ আল জাহিদ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরা সেবা বিভাগের যুগ্ম সচিব সৈয়দ বেলাল হোসেন এবং আইন সচিবের প্রতিনিধি সৈয়দ মুশফিকুল ইসলাম গত রোববার সকালে আদালতে হাজির হন। আদালতে দুদকের পে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান। আর ছিলেন জাহালমের বিষয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনটি আদালতের নজরে আনা আইনজীবী অমিত দাস গুপ্ত।

শুনানির শুরুতে খুরশীদ আলম খান বলেন, সোনালী ও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তথ্য পাওয়ার পর দুদক আবু সালেকের বিরুদ্ধে মামলা করে। দুদক কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ্ আল জাহিদ মামলার অনুসন্ধান করেন। তার অভিযোগপত্রে জাহালমের নাম উঠে আসে। টাঙ্গাইলের স্থানীয় চেয়ারম্যানরা জাহালমকে সনাক্ত করেন। এ পর্যায়ে বিচারক উষ্মা প্রকাশ করে বলেন, এ মামলায় যাকে আসামি করা উচিত ছিল, তাকে আসামি না করে সাী বানালেন। জজ মিয়া নাটক আরেকটি বানালেন নাকি? দুদক একটি স্বাধীন সংস্থা। বাংলাদেশের জন্য দুদকের মত একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। টিআইবি কী রিপোর্ট দিল সেটা আমাদের কনসার্ন না। কারণ টিআইবিও ভুল করতে পারে। দুদক যদি প্রোপারলি কাজ না করে তাহলে আমাদের যে উন্নয়ন হচ্ছে তার স্থায়ীত্ব থাকবে না।
দেশ পাকিস্তান হতে বেশি সময় লাগবে না, আমাদের ভিা করতে বসতে হবে। বিচারক বলেন, আমরা দুদকের কাজে হস্তপে করতে চাই না। দুদক স্বাধীনভাবে কাজ করুক এটা আমরাও চাই। আগেও আপনাদের (দুদক) ব্যাংকের দুর্নীতি মামলায় সাবধান করেছি। মনে রাখতে হবে এটি একটি স্বাধীন দেশ। অনেক মামলায় দেখেছি, আপনারা কোনো ব্যাক্তির বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নামার আগেই তাকে নোটিস দিয়ে দেন। অথচ পরে অনুসন্ধান করে দেখা যায় তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগই নেই। তাহলে কেন নোটিস দিচ্ছেন? একজন অপরাধী না হওয়ার পরও জেল খাটতে হল কেন? দুদককে স্বচ্ছ হতে হবে। এরপর আদালত জাহালমকে দুদকের ২৬ মামলা থেকে অব্যাহতির আদেশ দেয়।

দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান তখন বলেন, জাহালমের বিষয়টি যখনই আমাদের নজরে এসেছে, সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি গুরুত্বের সাথে নেওয়া হয়েছে। বিচারক তখন দুদকের আইনজীবীকে বলেন, আপনার যখন বুঝতে পারলেন যে লোকটা নির্দোষ, তখন আপনারা কী করেছেন? একদিনের জন্যও আপনারা তাকে রাখতে পারেন না। কেন আপনারা তার মুক্তির ব্যবস্থা করলেন না? জবাবে দুদকের আইনজীবী বলেন, অধিকতর তদন্তে জাহালমের বিষয়টি জানার পর দুদকের পিপিরা জাহালমের জামিনে কোনো আপত্তি করেননি। ইতোমধ্যে চারটি মামলা থেকে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রত্যাহার করা হয়েছে। এই মামলায় (সোনালী ব্যাংকের অর্থ জালিয়াতির ঘটনায় দুদকের মামলা) যে তদন্তকারীরা জাহালমের নামে ভুলভাবে অভিযোগপত্র দিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধ দুদক কী ব্যবস্থা নিয়েছে তা জানতে চায় আদালত।

জবাবে দুদকের আইনজীবী বলেন, জাহালমকে সব মামলা থেকে অব্যাহতি দিলে দুদকের কোনো আপত্তি থাকবে না। বিচারক তখন বলেন, জাহালমের কারাবাসের মেয়াদ একদিন বাড়বে, তো আপনার (দুদক) ওপর কমপেনসেশন বাড়বে। কমপেনসেট করতে হবে। দুদক করুক বা ব্যাংক করুক। ‘ভুয়া তদন্তের’ কোনো সুযোগ নেই মন্তব্য করে বিচারক বলেন,দুদককে অবশ্যই স্বচ্ছ হতে হবে। যারাই এর সঙ্গে জড়িত তাদের অভ্যন্তরীণভাবে চিহ্নিত করতে হবে। তাহলে আমাদের ইন্টারফেয়ার করার সুযোগ থাকবে না। যদি না হয় তাহলে কিন্তু আমরা করব। শুনানির শেষ পর্যায়ে আদালতে উপস্থিত এক উপ-কারামহাপরিদর্শকে আদালত বলেন, আপনারা আজই জাহালমকে রিলিজ করে দেবেন। দুদক এর খরচ দেবে।

এফএন/কেএস

বাংলাদেশ সময়: ১৭:১৩:০৬ ● ৫৩৪ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ