
মোঃ মহসীন খান
ডিসেম্বর বাঙালির জীবনে অহংকারের মাস। চারদিকে উড়ছে বিজয়ের পতাকা। এই মাসেই একে একে মুক্ত হয় শত্রুমুক্ত বাংলার গ্রাম, শহর ও বন্দর। প্রতিদিনই নতুন মুক্ত এলাকায় ওঠে বিজয়ের পতাকা। এটি বাঙালির বিজয়ের মাস, পাকিস্তান ও রাজাকারদের পরাজয়ের মাস।
আজ ১১ ডিসেম্বর, বৃহস্পতিবার। ১৯৭১ সালের এই দিনে যশোরে অনুষ্ঠিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জনসভা। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে দিনটি একটি অনন্য গৌরবময় অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত।
এই দিনে শত্রুমুক্ত যশোর টাউন হল ময়দানে প্রথম জনসভায় উপস্থিত ছিলেন প্রবাসী সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। এছাড়া উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা ফণী ভুবন মজুমদার, যশোরের গণপরিষদ সদস্য এডভোকেট রওশন আলী, মাগুরার সোহরাব হোসেন, প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য এডভোকেট মোশাররফ হোসেন, তবিবর রহমান সরদার এবং ঝিনাইদহের মঈনুদ্দীন মিয়াজী।
সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন ‘স্টপ জেনোসাইড’ নির্মাতা জহির রায়হান, ‘চরমপত্রের’ লেখক ও পাঠক এম আর আখতার মুকুল, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জনপ্রিয় খবর পাঠক সালেহ আহমেদ (প্রকৃত নাম সৈয়দ হাসান ইমাম), লন্ডন টেলিগ্রাফের পিটার পিল, নিউইয়র্ক টাইমসের সিডনি সানবার্গ, আকাশবাণীর উপেন তরফদারসহ দেশি-বিদেশি অসংখ্য সংবাদকর্মী।
৬ ডিসেম্বর বিকেলে পাকিস্তানি সেনারা যশোর ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে পালিয়ে যায়। ৭ ডিসেম্বর দলবীর সিংয়ের নেতৃত্বে মিত্রবাহিনী ক্যান্টনমেন্টের দখল নেয়। সেদিনই কলকাতায় অবস্থিত প্রবাসী সরকার ওয়ালিউল ইসলামকে যশোরের জেলা প্রশাসক নিয়োগ দেন। মুক্তিযোদ্ধা ও প্রশাসনের যৌথ উদ্যোগে ওই ঐতিহাসিক জনসভার আয়োজন করা হয়। সেই রাতেই বিশ্বের প্রায় সব বড় সংবাদমাধ্যম এ খবর প্রচার করে।
সেদিন ইয়াসিকা ৬৩৫ ক্যামেরায় মুহূর্তটি ধারণ করেন কুষ্টিয়ার মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হামিদ রায়হান। তিনি ১৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ভলেন্টিয়ার সার্ভিস কোরের আলোকচিত্রী হিসেবে যোগ দেন এবং ইতিহাস রক্ষায় অনন্য ভূমিকা পালন করেন। এদিন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ যশোরে বাংলাদেশের প্রথম জেলা প্রশাসন কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক সূচনা করেন।
একাত্তরের এই সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা ক্রমেই কোণঠাসা হয়ে পড়ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকা অভিমুখে অগ্রসর হচ্ছিলেন। পথের প্রতিটি জনপদেই উড়ছিল বিজয়ের পতাকা।
এই দিনে টাঙ্গাইলের মধুপুর অঞ্চলে ভারতীয় বাহিনীর ৭০০ সৈন্য অবতরণ করে। তাদের সঙ্গে পাকিস্তান বাহিনীর তীব্র লড়াই হয়। অন্যদিকে ভারতীয় নৌবাহিনী চট্টগ্রাম বন্দর, উপকূলীয় স্থাপনা, জাহাজ ও নৌযানের বিরুদ্ধে ব্যাপক আক্রমণ পরিচালনা করে।
মূলত ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বরেই বাংলাদেশের বিজয় নিশ্চিত হয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধা, মিত্রবাহিনী এবং দেশের সাধারণ মানুষ পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের প্রহর গুনছিলেন।
এদিন আকাশবাণী কলকাতা ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল মানেকশ’র আত্মসমর্পণের আহ্বান বিরামহীন প্রচার করতে থাকে। পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের অনুমতি থাকা সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ড. এ এম মালিক জাতিসংঘের মহাসচিবের হস্তক্ষেপ কামনা করে বার্তা পাঠান। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের শান্তিপূর্ণ সরকার গঠনের আহ্বান জানান। তবে সেই আহ্বান কোনো গুরুত্ব পায়নি।
– চলবে
লেখক: শিক্ষক ও সাংবাদিক