শিক্ষক-সাংবাদিকতা: রাষ্ট্রের সম্পদ, তবুও কি বিনা বেতনে লেখাও অপরাধ?

হোম পেজ » মুক্তমত » শিক্ষক-সাংবাদিকতা: রাষ্ট্রের সম্পদ, তবুও কি বিনা বেতনে লেখাও অপরাধ?
বুধবার ● ১০ ডিসেম্বর ২০২৫


 

প্রতিটি ছবি

মোঃ রোকনুজ্জামান শরীফ

বাংলাদেশের সংবিধান তার নাগরিকদের যে মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করেছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো বিবেক ও চিন্তার স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা- যা স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৯-এ। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, শৃঙ্খলা ও শালীনতার স্বার্থে যুক্তিসঙ্গত কিছু বিধিনিষেধ থাকলেও এই অধিকারগুলোর সারবস্তু অটুট, সর্বজনীন এবং গণতন্ত্রের প্রাণশক্তি।

 

শিক্ষকদের ক্ষেত্রে এই অধিকার প্রয়োগ নিয়ে দেশে নতুন আলোচনার সূচনা হয়েছে। বিশেষ করে (৩৭.০০.০০০.০৭৪.০৩০.০০০১.২-৩৩৩, তাং ৪/১২/২৫ ইং) সংশোধিত বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা-২০২৫-এ সাংবাদিকতাকে ‘আর্থিক লাভজনক’ পেশার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে শিক্ষকতার পাশাপাশি সাংবাদিকতা নিষিদ্ধ করার যে বিধান দেওয়া হয়েছে- তা শিক্ষাজগত, মিডিয়া মহল, লেখক-সাহিত্যিক সমাজ ও নাগরিক পরিসরে তীব্র আলোচনার জন্ম দিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে- এটি কি সাংবিধানিকভাবে ন্যায্য? এটি কি যুক্তিসঙ্গত? এটি কি বাস্তবসম্মত?

এই উপসম্পাদকীয় সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করে।

 

শিক্ষকরা সাংবাদিকতা করলে দোষ কোথায়?

বাংলাদেশের শিক্ষক সমাজ দেশের সবচেয়ে শিক্ষিত ও জ্ঞানসচেতন জনপদগুলোর একটি। বিশেষ করে বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের শিক্ষকদের ন্যূনতম যোগ্যতা অনার্স/স্নাতক বা স্নাতকোত্তর; অনেকে বিএড-এমএড, এমনকি এলএলবি-এলএলএম, এমফিল ও পিএইচডি পর্যন্ত ডিগ্রিধারী। তাদের মধ্যে অনেকে সাহিত্যচর্চা করেন, প্রবন্ধ লেখেন, গবেষণায় যুক্ত থাকেন। স্বাভাবিকভাবেই সাংবাদিকতা বা কলাম লেখাও তাদের সৃজনশীল পরিসরে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।

বস্তুনিষ্ঠভাবে বললে- শিক্ষকরাই বইয়ের সঙ্গে সবচেয়ে নিবিড়ভাবে যুক্ত। পাঠ, ভাবনা, বিশ্লেষণ- এসব তাদের দৈনন্দিন কাজের অংশ। ফলে সাংবাদিকতা পেশায় থাকলে তাদের ভাষা, বিশ্লেষণ ও সৃজনশীলতা স্বাভাবিকভাবেই একটি উন্নত মান তৈরি করতে পারে।

কিন্তু বাস্তবতা হলো- সারা দেশে শিক্ষক-সাংবাদিকের সংখ্যা হাতে গোনা। একটি উপজেলায় দুই-একজন শিক্ষক সাংবাদিকতা করতে পারেন; অনেক উপজেলায় একজনও নেই। যারা করেন- তারা বেশিরভাগই কোনো পারিশ্রমিক পান না। এটি তাদের পেশা নয়; বরং নেশা, চেতনা ও সৃজনশীলতার একটি ক্ষেত্র।

অন্যদিকে দেশে সাংবাদিকতা পেশায় বিভিন্ন ক্ষেত্রের মানুষ- ব্যাংকার, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, এনজিও কর্মকর্তা, কৃষি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, এমনকি রাজনৈতিক কর্মীও লিখছেন, সংবাদ সংগ্রহ করছেন। সমাজের এই বহুমাত্রিক অংশগ্রহণ সাংবাদিকতাকে সমৃদ্ধ করে।

তাহলে শিক্ষকরা সাংবাদিকতা করলে সমস্যা কোথায়?

 

হলুদ সাংবাদিকতা কেন হচ্ছে- দায়ী কে?

 

বর্তমান বাস্তবতাই হলো- বাংলাদেশের অধিকাংশ মিডিয়া প্রতিষ্ঠান সম্পাদকীয় নীতিমালা অনুসরণ করে কিংবা যোগ্যতা দেখে সাংবাদিক নিয়োগ করে না। সুপারিশ, আর্থিক লেনদেন, স্বজনপ্রীতি- এসবই বেশি কার্যকর। মোবাইল হাতে নিয়ে খুব কম জ্ঞানেই অনেকেই মাঠে নেমে ‘সাংবাদিক’ হয়ে যান।

ফলে তৃণমূল সাংবাদিকতার মধ্যে ভাষাগত দুর্বলতা, তথ্য যাচাইহীনতা, উত্তেজনাপূর্ণ শিরোনাম, ব্ল্যাকমেইলিং প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। যা থেকে ‘হলুদ সাংবাদিকতা’র অভিযোগ জন্ম নিচ্ছে।

কিন্তু এর জন্য শিক্ষকদের দায়ী করা যায় না। বরং বলা যায়- যদি শিক্ষকরা সাংবাদিকতায় অংশ নেন, তাহলে ক্ষেত্রটি আরও শিক্ষিত ও পেশাদার হবে।

 

নীতিমালার নতুন বাধা: সাংবিধানিক নজির কি?

 

সংশোধিত এমপিও নীতিমালার ১১.১৭ (ক) ও (খ) ধারায় বলা হয়েছে-

> এমপিওভুক্ত শিক্ষক–কর্মচারী আর্থিক লাভজনক কোনো চাকরি বা পদে থাকতে পারবেন না।

বেসরকারি সংস্থা, প্রতিষ্ঠান, সাংবাদিকতা, আইন পেশায় বেতন বা সম্মানীর বিনিময়ে কাজ করাও নিষিদ্ধ।

নীতিমালার উদ্দেশ্য পরিষ্কার- দুটি আয় থেকে বিরত রাখা। এই যুক্তি সরকারি চাকরিতে প্রচলিত বিধানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

কিন্তু প্রশ্ন হলো- যারা বিনা বেতনে লেখা বা সাংবাদিকতা করেন, তাদের কেন নিষিদ্ধ করা হবে?

 

সাংবাদিকতা কি শুধুই বেতনের বিনিময়ের কাজ?

যারা প্রবন্ধ লেখেন, সাহিত্যচর্চা করেন, কলাম লেখেন- তাদের কি আলাদা পেশা বলা যায়?

প্রশ্ন আরও আছে-

এটি কি সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৯ লঙ্ঘন নয়?

চিন্তার স্বাধীনতা কি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে না?

মতপ্রকাশের অধিকার কি সংকুচিত হচ্ছে না?

লেখালেখি কি আর্থিক পেশার মধ্যে পড়ে?

এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরি।

 

 

শুধুই শিক্ষক- কারণ কি?

বাংলাদেশে বেসরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে অনেকেই সাংবাদিকতা করেন। সরকারি কর্মকর্তারা পর্যন্ত পরিবার ও স্বজনের নামে, কখনো গোপনে বা পরোক্ষভাবে বিভিন্ন ব্যবসায় যুক্ত থাকেন- এটি ওপেন সিক্রেট। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো বিধিনিষেধ হয় না।

কেন শুধু শিক্ষকদের ঘাড়েই দায় চাপানো হচ্ছে? এটি কি একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠী–বিরোধী নীতি? এটি কি শিক্ষকসমাজকে অপমান ও সংবিধানপ্রদত্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত করা নয়?

আরও বড় উদ্বেগ হলো- বেসরকারি স্কুল–কলেজে শিক্ষকতার পেশা সরকারি চাকরির মতো পূর্ণকালীন নাও হতে পারে। তাদের অনেকে আর্থিক সংকটে ভুগেন। সাংবাদিকতা তাদের জন্য আর্থিক উপার্জনের পথ নয়- বরং মানসিক খাদ্য, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা।

 

 

সাংবাদিকতা শুধু সংবাদ সংগ্রহ নয়- এটি সৃজনশীলতা

 

সাংবাদিকতা এখন আর কেবল পাঁচটি খবর সংগ্রহ করাকে বোঝায় না-

নানা ধরণের ফিচার, বিশ্লেষণ, সাহিত্যিক কলাম, ব্যক্তিজীবনভিত্তিক লেখা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সমাজবিষয়ক রিপোর্টিং।

একজন শিক্ষক এই কাজ করলে সমাজ উপকৃত হয়- এটি বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। পৃথিবীর বিখ্যাত সাহিত্যিক, গবেষক, চিন্তাবিদদের বহুজন ছিলেন শিক্ষক ও সাংবাদিক দুই-ই। বাংলাদেশের ঐতিহ্যেও রয়েছে।

নদীভাঙন বা দুটো মৃত সংবাদ করলেই সাংবাদিকতা নয়। সমুদ্রের বিশালতা যেমন বিস্তৃত, সাংবাদিকতার ক্ষেত্রটিও তেমন প্রসারিত।

তৃণমূলের কিছু ব্যক্তি ‘স্টিকার সাংবাদিকতা’ করেন- এটি সত্য। কিন্তু তাই বলে সাংবাদিকতা পেশাকে সংকুচিত করে দেখা যাবে না। একজন শিক্ষক যেভাবে সমাজ বিশ্লেষণ করেন, তা এক ভিন্ন উচ্চতা তৈরি করে। এটি রাষ্ট্র ও সমাজকে সমৃদ্ধ করে।

 

 

নীতিমালা হোক যুক্তিযুক্ত, অন্ধ নয়

 

হ্যাঁ- যদি কোনো শিক্ষক বেতনভুক্ত সাংবাদিকতা করেন, তাহলে আপত্তি থাকতে পারে। এই নিষেধাজ্ঞা কেবল শিক্ষক নয়- সব সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীর ক্ষেত্রেই সমান হওয়া উচিত।

কিন্তু- যদি তিনি বিনা পারিশ্রমিকে, নিজের মেধা, সৃজনশীলতা, চিন্তা ও লেখালেখি দিয়ে সমাজের কল্যাণ করে থাকেন- তাহলে তাকে হয়রানি করা সাংবিধানিকভাবে অসঙ্গত।

নীতিমালা সমাজকে উন্নত করতে করা হয়- মানুষকে ‘নিষিদ্ধ’ করার জন্য নয়।

 

 

শেষ কথা: শিক্ষক–সাংবাদিকতা- রাষ্ট্রের জন্য সম্পদ, হুমকি নয়

শিক্ষকদের সৃজনশীল লেখালেখি ও সাংবাদিকতা সমাজকে আলোকিত করে- অন্ধকার নয়।

অশিক্ষিত, চাঁদাবাজ বা অযোগ্য লোকদের কাছে সাংবাদিকতা ছেড়ে দিলে সমাজে অরাজকতা বাড়বে।

অন্যদিকে শিক্ষিত ও ভদ্র মানুষদের এই পেশায় অংশগ্রহণ পেশাটিকে করবে মর্যাদাবান, আধুনিক এবং দায়িত্বশীল।

অতএব, নীতিমালাকে মানবিক, বাস্তবসম্মত ও সংবিধানসম্মত হতে হবে।

গণতন্ত্রে মতপ্রকাশ কোনো অপরাধ নয়- এটি মানুষের জন্মগত অধিকার।

শিক্ষকরা যদি সৃজনশীলতার কারণে লেখেন, সাংবাদিকতা করেন- সমাজ উপকৃত হয়, রাষ্ট্র উপকৃত হয়, গণতন্ত্র শক্তিশালী হয়।

নীতিমালার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত- সৃজনশীলতাকে বন্ধ করা নয়, বরং উন্নত করা।

বিনা বেতনভুক্ত সাংবাদিকতা বা লেখা–লেখিতে বাধা দেওয়া কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত হতে পারে না।

রাষ্ট্রকে এ বিষয়ে আরও বিবেচক, মানবিক এবং বাস্তবভিত্তিক হতে হবে।

 

লেখক:

শিক্ষক ও সাংবাদিক

সাধারণ সম্পাদক, মঠবাড়িয়া প্রেসক্লাব, পিরোজপুর

sharifsstyle@gmail.com

বাংলাদেশ সময়: ১৪:৪১:৩১ ● ৪৪ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ