করোনা আমফানের ক্ষতি কাটাতে- কলাপাড়ায় ফের সবজি চাষে নেমেছে হাজারো চাষী

প্রথম পাতা » পটুয়াখালী » করোনা আমফানের ক্ষতি কাটাতে- কলাপাড়ায় ফের সবজি চাষে নেমেছে হাজারো চাষী
বৃহস্পতিবার ● ১১ জুন ২০২০


কলাপাড়ায় ফের সবজি চাষে নেমেছে হাজারো চাষী

মেজবাহউদ্দিন মাননু, কলাপাড়া (পটুয়াখালী) সাগরকন্যা অফিস॥

কুমিরমারা গ্রামে বাড়ি কৃষক জাকির হোসেনের। জীবিকার প্রয়োজনে অনেক কাজ করেছেন। এখন একজন সফল সবজি চাষী। সবশেষ ৪৫ শতক জমিতে করলা, ২৫ শতক জমিতে ঝিঙে, ৩৩ শতক জমিতে চিচিঙ্গা, ৪৫ শতক জমিতে লাউ, ১৫ শতকে চালকুমড়ো, ১২ শতকে শসা, ২৫ শতকে কাঁচা মরিচ, পাঁচ শতকে বোম্বাই মরিচ চাষাবাদ করেছিলেন। ফলনও ছিল খুব ভাল। এ জমি আবাদে চাষের খরচ, বীজ কেনা, লাগানো, পরিচর্যা, কীটনাশক-সার প্রয়োগ নিয়ে এক লাখ কুড়ি হাজার টাকা খরচ করেছেন। করোনাকালে ক্ষেতজুড়ে ফসল ছিল। কিন্তু কাঙ্খিত দাম পায়নি। কারণ কলাপাড়ায় বিভিন্ন মেগাপ্রকল্পে কর্মরত ছিল প্রায় ২০ হাজার বহিরাগত শ্রমিক। এজন্য স্থানীয় ছাড়াও সবজির বাড়তি চাহিদা ছিল। এসব শ্রমিকরা করোনাকালের ছুটিতে থাকায় ফসলের দাম পায়নি জাকির হোসেন। তারপরও অন্তত খরচের টাকা পোষাতে প্রতিদিন কমবেশি সবজি বিক্রি করছিলেন। কিন্তু ঘুর্ণিঝড় আমফান তার শেষ সর্বনাশ করে দেয়। ফসলসহ ক্ষেত লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। যেখানে প্রায় পাঁচ লাখ টাকা বিক্রির কথা ছিল। উল্টো এখন জাকির হোসেন নিঃস্ব। মানুষটি পথে বসে গেছেন। কৃষিতে স্বাবলম্বী মানুষটি এখন দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। নিজের কৃষিজমি নেই। তাই অন্যের এক কড়া (তিন শতক) জমিতে বছরে এক মন ধানের বিনিময় চাষ করেন সবজির। এখন ফের কীভাবে চাষাবাদ শুরু করবেন তা জানা নেই। ঘুরে দাড়ানো তো দুরের কথা। কোমর সোজা করতে পারছেন না এ সফল চাষী। একই দশা সুলতান গাজীর। আদর্শ কৃষক বলতে যা বোঝায়। এ চাষীর নাম গ্রামজুড়ে। যেন সকল ধরনের সবজি আবাদে পারদর্শী এই মানুষটি। জীবনের ৪০ টি বছর সবজির ক্ষেতে কাজ করেছেন। জীবিকার জন্য লড়ছেন সবজির ক্ষেতে। করোনাকালের দাম না পাওয়ার কষ্টের সঙ্গে আমফানের তান্ডবে মানুষটি দিশেহারা হয়ে আছেন। ৬০ শতক জমির সবজির ফলন সম্পুর্ণভাবে নষ্ট হয়ে গেছে। একই দশা আজিজ হাওলাদার, সালাহউদ্দিন গাজী, আব্দুল হক গাজীর, মাসুদ গাজীর, শাহজাহান গাজী, মনির ফকিরের। সবুজ সৈনিক এসব প্রান্তিকের মানুষগুলো নিঃস্ব হয়ে গেছেন। কেন্দ্রের মানুষকে নিত্য সরবরাহ করতনে শাক-সবজিসহ বিভিন্ন ধরনের ফসল। যা দিয়ে চলে কলাপাড়ার মানুষের সবজির চাহিদা। মজিদপুর গ্রামের আবুল কালাম হাওলাদারের এক একর জমি ফসলে ছিল পরিপূর্ণ। মানুষটি এখন দু’চোখে শর্ষেফুল দেখছেন। সোনাতলার নজরুল আকন, অহিদ আকন, জলিল কাজী, আনসার কাজী, ইসাহাক হাওলাদারের সবজির ক্ষেতগুলো মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। এভাবে অন্তত পাঁচটি গ্রামের শতাধকি সবজি চাষীর সঙ্গে কথা বলে, ক্ষেতের ফসলহানির দৃশ্য দেখে যে কেউ হতবাক বনে যাবেন। মানুষগুলো আবার ঘুরে দাড়ানোর চেষ্টা করছেন কেউ কেউ। তৈরি করছেন ক্ষেত। চারা করছেন কেউ কেউ। কিন্তু আর্থিক সঙ্কটে এরা সবাই কাহিল হয়ে পড়েছেন। নিজেদের শরীরকে পুঁজি করে মানুষগুলো ১২ মাস ক্ষেতের ফলানো ফসল দিয়ে সংসারের যোগান দেয়। পাশাপাশি লাভের মুখ দেখেন ফি বছর। কেউ নিজেকে কামলা থেকে পরিণত করেছেন গেরস্ত পরিবারে। কিন্তু সফল এ চাষীরা এখন নতুন ক্ষেত তৈরি করার মতো পুঁজির সঙ্কটে দিশেহারা হয়ে গেছেন । কখনও উপজেলা নির্বাহী অফিসারের অফিসে, কখনও কৃষি অফিসে দৌড়াচ্ছেন। এসব কৃষক করোনাকালে পায়নি কোন খাদ্য সহায়তা। এমন এন্তার অভিযোগ সকলের। এনিয়ে তাদের কোন আক্ষেপও ছিল না। কারণ ক্ষেত ভরা ফলন বিক্রি করে কমবেশি আয় করতেন। কিন্তু করোনার ধকলের পওে ঘুর্ণিঝড় আমফান সব যেন নিঃস্ব করে দিয়েছে। হতাশার কন্ঠে সুলতান গাজী জানালেন, কোথাও কোন সরকারি-বেসরকারি সহায়তা না পেয়ে দুই হাজার টাকা ধার-দেনা করে ফের বীজ কিনেছেন। এমন সঙ্কটে আগে কখনও পড়েননি বলে জানালেন। আবার ক্ষেতের কাজে নামছেন। আক্ষেপ, ১২ মাস প্রান্তিক এই মানুষগুলো কৃষিসহ শাক-সবজি উৎপাদন করেন, দেশের কৃষি অর্থিনীতির চাকা সচল রাখছেন। আর আজকে আর্থিক সঙ্কটে তাদের জীবিকার চাকা অচল হয়ে গেছে। কৃষক জাকির হোসেন জানান, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এক ইঞ্চি জায়গাও খালি রাখতে নিষেধ করেছেন। কিন্তু তারা কোন ধরনের সহায়তা না পাওয়া সবুজে ভরা থাকা ক্ষেতগুলো এখন বিরানভূমি।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল মান্নান জানান, করোনার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সবজিচাষীদের ওপর। সবজিরও চাহিদা কমে গেছে। তারপরে ঘুর্ণিঝড় আমফানের ক্ষতি। তবে এ ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য সরকারিভাবে কৃষককে সহায়তা করা হবে। কৃষি বিভাগের দেয়া তথ্যমতে, কলাপাড়ার মোট জনসংখ্যার প্রতিদিন প্রায় ৪০-৪৫ টন শাক-সবজির প্রয়োজন। এছাড়া উন্নয়ন কাজের সঙ্গে জড়িত বাড়তি ১২ হাজার শ্রমিকের জন্য প্রয়োজন ছিল আরও দৈনিক প্রায় তিন টন। আর এসব কারণে এখন সবজির চাষীসহ বিক্রেতারা করোনার প্রভাবে অনেকটা লোকসানের কবলে।
কৃষক রুহুল আমিন জানান, পুই শাকের ক্ষেতটি এখন নষ্ট হয়ে গেছে। পাতায় লাল লাল স্পট পড়েছে। এ শাক কেউ কিনবেনা। বিক্রির মতো প্রায় ১০০ মন শাক মাঠেই নষ্ট হয়ে গেছে। যা বিক্রি করতে পারলে ৫০ হাজার টাকা পেতেন। এসব প্রান্তিক চাষীর দুরবস্থা চোখে না দেখলে বোঝার উপায় নেই। তারপরও ফের ক্ষেতের পরিচর্যায় নেমেছেন। এদরই একজন আব্দুল বারেক হাওলাদার জানান, কৃষি প্রণোদনা তো দুরের কথা, করোনার দুর্যোগ থেকে এখন পর্যন্ত এক ছটাক চাল ভাগ্যে জোটেনি। কুমিরমারা গ্রামের শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ সারা বছর সবজি-শাকের আবাদ করেন। এরা বেশি একটা ধানের আবাদ করেন না বলে জানালেন সুলতান গাজী। একই বক্তব্য জাকির হোসেনের। তার মন্তব্য কোন ধরনের খাদ্য থেকে শুরু করে প্রণোদনার সহায়তা জোটেনি। গ্রামটির শতাধিক শাক-সবজি চাষীর কোটি টাকার ক্ষতি হয়ে গেল করোনা ও আমফানে। একই দশা এলেমপুর, আমিরাবাদ, পুর্বসোনাতলা, মজিদপুর, গুটাবাছা, নাওভাঙ্গা, গামইরতলার চাষীদের। গোটা নীলগঞ্জে ২০০ কৃষক পরিবার এখন দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। তাঁদের সবজিসহ সবকিছু নষ্ট হয়ে গেছে। নষ্ট হয়ে গেছে সবজির লাখো চারা গাছ। গোটা উপজেলায় প্রায় ছয় হাজার সবজি চাষীর এমন সর্বনাশ হয়েছে। এরা পথে বসে গেছে। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জানান, করোনায় ক্ষতির কবলে পড়া চাষীরা আমফানে বাকিটা ক্ষতির কবলে পড়ল। তাদের হিসেব মতে এক হাজার হেক্টর সবজির ক্ষেতের ৭০ ভাগ ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। এছাড়া ৫০ হেক্টর মিষ্টি আলু, ৫৫০ হেক্টর মরিচ ক্ষেতের ফসল আমফানের তান্ডবে নষ্ট হয়ে গেছে। তবে এসব কৃষকরা প্রশ্ন তুলেছেন, উপজেলা পরিষদ কিংবা ইউনিয়ন পরিষদের বাজেটে কৃষিখাতের টাকা যায় কোথায়। খরচ হয় কোনখাতে।

এমইউএম/এমআর

বাংলাদেশ সময়: ২১:৩৬:১৪ ● ৩৮১ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ