বাংলাদেশের দুর্নীতি বেড়েছে: ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল

প্রথম পাতা » জাতীয় » বাংলাদেশের দুর্নীতি বেড়েছে: ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল
মঙ্গলবার ● ২৯ জানুয়ারী ২০১৯


বাংলাদেশের দুর্নীতি বেড়েছে: ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল

ঢাকা সাগরকন্যা অফিস॥

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ‘দুর্নীতির ধারণাসূচকে’ বাংলাদেশের অবস্থানের ছয় ধাপ অবনমন ঘটেছে। অর্থাৎ বাংলাদেশে দুর্নীতি আগের চেয়ে বেড়েছে। জার্মানির বার্লিনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান টিআইর প্রকাশ করা দুর্নীতির ধারণাসূচক ২০১৮-এর প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়েছে।
বিশ্বের ১৮০টি দেশ ও অঞ্চলের ২০১৮ সালের দুর্নীতির পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে টিআই  মঙ্গলবার (২৯ জানুয়ারি) এই সূচক প্রকাশ করে। সূচকের ঊর্ধ্বক্রম অনুযায়ী (ভাল থেকে খারাপ) বাংলাদেশের অবস্থান এবার ১৪৯ নম্বরে। গেলবার ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৪৩ নম্বরে। আবার অধঃক্রম অনুযায়ী (খারাপ থেকে ভালো) বিবেচনা করলে বাংলাদেশ আগের ১৭তম অবস্থান থেকে নেমে গেছে ১৩তম অবস্থানে। ১০০ ভিত্তিতে এই সূচকে বাংলাদেশের স্কোর এবার ২ পয়েন্ট কমে ২৬ হয়েছে। এই স্কেলে শূন্য স্কোরকে দুর্নীতির ব্যাপকতার ধারণায় সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত এবং ১০০ স্কোরকে সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত বা সর্বোচ্চ সুশাসনের দেশ হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
এই সূচকে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের চেয়ে বাজে অবস্থা কেবল আফগানিস্তানের। অধঃক্রম অনুযায়ী (খারাপ থেকে ভালো) আফগানিস্তানের অবস্থান এবার নবম। এমন এক সময়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের এই প্রতিবেদন এল যখন টানা তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করা আওয়ামী লীগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির কথা বলছে। সরকার গঠনের পর শুক্রবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া প্রথম ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বলেছেন, আমি জানি, দুর্নীতি নিয়ে সমাজের সর্বস্তরে অস্বস্তি রয়েছে। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের নিজেদের শোধরানোর আহ্বান জানাচ্ছি। আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে দুর্নীতি উচ্ছেদ করা হবে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান গতকাল মঙ্গলবার ধানম-ির মাইডাস সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এবারের প্রতিবেদনের বিভিন্ন দিক এবং বাংলাদেশের দুর্নীতির পরস্থিতি তুলে ধরেন। বাংলাদেশের অবনমনকে ‘বিব্রতকর’ হিসেবে বর্ণনা করে তিনি বলেন, ‘উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতিবাজদের বাদ দিয়ে নিম্ন ও মধ্যম সারিতে ব্যবস্থা নেওয়ায়’ বাংলাদেশ আশানুরূপ উন্নতি করতে পারছে না। আমাদের দুর্নীতিবিরোধী অভিযান নিম্ন ও মধ্যম পর্যায়ে সীমাবদ্ধ। উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতিবাজদের দিকে আমাদের নজর দিতে হবে এখন। দল ও পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘শূন্য সহিষ্ণুতা’ দেখানোর বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণাকে সংবাদ সম্মেলনে ইতিবাচক হিসাবে বর্ণনা করেন ইফতেখারুজ্জামান। সেই সঙ্গে এ অঙ্গীকার বাস্তবায়নে উদ্যোগী হওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, এজন্য জাতীয় দুর্নীতি বিরোধী কৌশল প্রণয়ন করা জরুরি বলে আমরা মনে করি। এই ধরনের কৌশল প্রণয়ন করা উচিত এবং এটা করা সম্ভব। ব্যক্তির পরিচয় ও অবস্থানের ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করতে না পারলে শূন্য সহিুতার বিষয়টি বক্তব্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। টিআই এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, তালিকায় এবারও সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে আফ্রিকার দেশ সোমালিয়া; তাদের স্কোর গতবারের তুলনায় ১ পয়েন্ট বেড়ে ১০ হলেও অবস্থঅনের নড়চড় হয়নি। এরপরে রয়েছে যথাক্রমে সিরিয়া, সাউথ সুদান, ইয়েমেন, উত্তর কোরিয়া, সুদান, গিনি-বিসাউ, ইকুয়েটোরিয়াল গিনি, আফগানিস্তান ও লিবিয়া।
অন্যদিকে সর্বোচ্চ ৮৮ স্কোর নিয়ে তালিকায় সবচেয়ে ভালো অবস্থানে উঠে এসেছে ডেনমার্ক। স্কোর কমায় গতবারের তালিকায়ে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে থাকা নিউ জিল্যান্ড এবার নেমে গেছে দ্বিতীয় অবস্থানে। এর পরে রয়েছে ফিনল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, নরওয়ে, নেদারল্যান্ডস, কানাডা ও লুক্সেমবুর্গ। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, তাদের এবারের সমীক্ষায় দুই তৃতীয়ংশের বেশি দেশের স্কোর ৫০ এর নিচে। আর প্রতিবেদনের ১৮০টি দেশের গড় স্কোর দাঁড়িয়েছে ৪৩। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এবারের সূচকে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে ভুটান। ৬৮ স্কোর নিয়ে ভুটানের অবস্থান সূচকের ঊর্ধ্বক্রম অনুযায়ী ২৫ নম্বরে। এরপর ভারত ৭৮ (স্কোর ৪১), শ্রীলঙ্কা ৮৯ (স্কোর ৩৮), পাকিস্তান ১১৭ (স্কোর ৩৩), মালদ্বীপ ১২৪ (স্কোর ৩১), নেপাল ১২৪ (স্কোর ৩১) এবং যুদ্ধ বিধ্বস্ত আফগানিস্তান ১৭২তম (স্কোর ১৬) অবস্থানে রয়েছে। ২৬ স্কোরে বাংলাদেশের সঙ্গে একই অবস্থানের রয়েছে- সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক ও উগান্ডা। অর্থ পাচার ঠেকানোর উদ্যোগ ‘না নেওয়া’, গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের মত প্রকাশের অধিকার ‘সঙ্কুচিত হওয়া’ এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়মের মধ্যে আনতে ‘না পারা’কে বাংলাদেশের অবনমনের কারণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয় টিআইবির সংবাদ সম্মেলনে।
দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) আরও উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দুর্নীতি দমনের ক্ষেত্রে তারা সরকারের আজ্ঞাবহ নয়, সেই ম্যান্ডেট তাদের আছে। পরিচয় ও অবস্থানের ঊর্ধ্বে উঠে দুর্নীতিবাজদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। এদিকে, উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতি বিচারের আওতায় না আসা, ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতে জালিয়াতি, অর্থ পাচার ও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে জবাবদিহি প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বল হয়ে যাওয়াকে বাংলাদেশে দুর্নীতি বেড়ে যাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। এই দুর্নীতি বাড়ার পেছনে কী কী কারণ থাকতে পারে, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান সে প্রসঙ্গে বলেন, যেসব কারণে আমাদের ফল ভালো হয়নি বলে আমরা মনে করি, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে যে আমাদের দুর্নীতিবিরোধী অঙ্গীকার থাকে, রাজনৈতিক ঘোষণা থাকে, কিন্তু সেটার বাস্তব প্রয়োগ হয় না। উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গ, খুব কম ক্ষেত্রেই তাদের বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হয় বা (তেমন) দৃষ্টান্ত রয়েছে।
অবৈধ অর্থ পাচারের যে বিষয়টি, সেটি অবশ্যই এই সূচকে বিবেচিত হয়ে থাকতে পারে। দুর্নীতির সূচকে উন্নতির জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছার বাস্তবায়ন ও দুর্নীতি দমন কমিশনের কার্যকর ভূমিকাসহ বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ জানায় টিআইবি। এ প্রসঙ্গে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের প্রাক্কালে এবং নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে অত্যন্ত জোরালোভাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। বাংলাদেশে দুর্নীতিবাজদের ঠাঁই হবে না। এটির কার্যকর ব্যবহার, এটির প্রয়োগ এবং এটিকে কারো প্রতি ভয়, করুণা না করে বাস্তবায়ন করার যে অঙ্গীকার, সেটি থাকতে হবে। সেটির পদ্ধতি আবিষ্কার করতে হবে। এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে, দুর্নীতি করলে যে শাস্তি পেতে হয়, সেটি নিশ্চিত করা। যারা দুর্নীতি করবে, উচ্চ পর্যায়েরই হোক, যেই পর্যায়েরই হোক না কেন, যেন তারা আবার বিচারহীনতার সংস্কৃতি উপভোগ করবেন, সেটি যেন না হয়। তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে বলতে গিয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, র‌্যাঙ্কিংয়ের বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থানটা বিব্রতকর। কারণ, বাংলাদেশের র‌্যাঙ্কিংয়ে ওপর থেকে যদি হিসাব করা হয়, ১৮০টি দেশের মধ্যে আমরা এবার ১৪৯তম স্থান পেয়েছি। যেটি ২০১৭ সালের তুলনায় ছয় ধাপ নিচে। দক্ষিণ এশিয়ার যে আটটি দেশ এই সূচকে অন্তর্ভুক্ত আছে, সে আটটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এবারও দ্বিতীয় সর্বনিম্ন। আমাদের পরেই আফগানিস্তান। এবং এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে যে ৩১টি দেশ এই সূচকে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, তাদের মধ্যে আমরা চতুর্থ সর্বনিম্ন। আমাদের পরে আছে শুধু কম্বোডিয়া, আফগানিস্তান ও নর্থ কোরিয়া। যে কারণে আমরা বলছি এটা আমাদের জন্য বিব্রতকর, বলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক। রাজনীতি ও প্রশাসনে দুর্নীতির ব্যাপকতা সম্পর্কে ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারী, সংশ্লিষ্ট খাতের গবেষক ও বিশ্লেষকদের ধারণার ওপর ভিত্তি করে ১৯৯৫ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী দেশগুলোর দুর্নীতির সূচক প্রকাশ করে আসছে জার্মানভিত্তিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল।

এফএন/এমআর

বাংলাদেশ সময়: ১১:১৮:২৮ ● ৪৮৮ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ