বিদেশী ঋণের দিকে ঝুঁকছে বেসরকারি উদ্যোক্তারা

প্রথম পাতা » জাতীয় » বিদেশী ঋণের দিকে ঝুঁকছে বেসরকারি উদ্যোক্তারা
শুক্রবার ● ২৪ মে ২০১৯


বিদেশী ঋণের দিকে ঝুঁকছে বেসরকারি উদ্যোক্তারা

ঢাকা সাগরকন্যা অফিস॥

দেশের বেসরকারি উদ্যোক্তারা বিদেশী ঋণের দিকে বেশি ঝুঁকছে। মূলত উচ্চ সুদ থেকে বাঁচতেই উদ্যোক্তারা ওই পথ বেছে নিচ্ছে। তাতে দেশের দায় বেড়ে যাচ্ছে। বর্তমানে ব্যাংকগুলোতে টাকার তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে। আর সঙ্কট মেটাতে ব্যাংকগুলো উচ্চ সুদে আমানত সংগ্রহ করছে। ফলে বেড়ে গেছে ঋণের সুদহার। অথচ লাইবরের (লন্ডন ইন্টার ব্যাংক রেট) সাথে অতিরিক্ত ৪ শতাংশ দিলেই মিলছে বিদেশী ঋণ। তাতে বিদেশী ঋণের সুদ পড়ছে মাত্র সাড়ে ৬ শতাংশ। কিন্তু বিদেশী ঋণের সুদ আপাতদৃষ্টিতে সস্তা মনে হলেও ডলার টাকার বিনিময় হারের হিসাব করলে কার্যকর সুদহার অনেক বেড়ে যাবে। একই সাথে দেশের ওপর বাড়বে সুদসহ বিদেশী ঋণের দায়। ব্যাংকিং খাত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বেসরকারি পর্যায়ে বিগত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি মিলে বিদেশী ঋণের স্থিতি প্রায় ১ হাজার ৪৫০ কোটি ডলার দাঁড়িয়েছে। যা স্থানীয় মুদ্রায় প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকার (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা হিসেবে) মতো। তার মধ্যে প্রায় সাড়ে ৯ বিলিয়ন বা প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকাই স্বল্পমেয়াদি (এক বছরের কম মেয়াদে) ঋণ। আর বেসরকারি পর্যায়ে বৈদেশিক ঋণ বেড়ে যাওয়ায় দেশের ওপর দায় বাড়ছে। কারণ ওসব ঋণ হলো সরবরাহ ঋণ, যা হার্ড লোন হিসেবে পরিচিত। অর্থাৎ বাজার রেটে ওই ঋণের সুদ নির্ধারণ হয়। ওই কারণে ওসব ঋণের সুদ তুলনামূলকভাবে বেশি। আবার ওসব ঋণ বিদেশী মুদ্রায় নেয়া হয়। কিন্তু কাজে লাগানো হয় স্থানীয় মুদ্রায়। আবার পরিশোধও করা হয় বিদেশী মুদ্রায়। সুতরাং ওসব ঋণ বেশি হলে দেশের ওপর চাপ বাড়ে। ওই কারণে ওসব ঋণ সীমার মধ্যে রাখাটাই দেশের জন্য ভালো।
সূত্র জানায়, দেশের বেসরকারি উদ্যোক্তাদেও যখন বিদেশী ঋণ আনার অনুমোদন দেয়া হয়, তখন দেশীয় ব্যাংকগুলোর তারল্য সঙ্কট চলছিল। অর্থাৎ বিনিয়োগকারীদের ঋণ দেয়ার মতো পর্যাপ্ত অর্থ ব্যাংকগুলোর হাতে ছিল না। টাকার সঙ্কটের কারণে ঋণের সুদ হারেও আকাশমুখী হয়। তখন ব্যাংকগুলোও উচ্চ সুদে আমানত সংগ্রহ করে। তখন দেশে সর্বোচ্চ সুদের হার ছিল ১৪ টাকা। অর্থাৎ ব্যাংকগুলো ১০০ টাকা আমানত নিতে সর্বোচ্চ ১৪ টাকা ব্যয় করেছে। ২০১০-১১ অর্থবছরের দিকে ওই সময়কাল ছিল। ব্যাংকগুলো উচ্চ সুদে আমানত নিয়ে ১৮ থেকে ২০ শতাংশ হারে ঋণ দিতে থাকে। তাতে পণ্যের উৎপাদন ব্যয়ও বেড়ে যায়। বেড়ে যায় মূল্যস্ফীতি। এমন পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যবসায়ীদের বৈদেশিক ঋণ আনার অনুমোদন দেয়। বলা চলে তখন থেকে বেসরকারি পর্যায়ে বৈদেশিক ঋণ আসতে থাকে। সর্বোচ্চ ৫ বছর মেয়াদি ওসব ঋণ আনতে ব্যবসায়ীরা ক্ষেত্রবিশেষ সাড়ে ৪ থেকে ৬ শতাংশ পর্যন্ত ব্যয় করে। তারপর অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা তাদের তহবিল সঙ্কট মেটায়। সর্বোচ্চ ১ বছরের কম মেয়াদি ওসব ঋণ আনতেও ক্ষেত্রবিশেষ সর্বোচ্চ সাড়ে ৬ শতাংশ সুদ দিয়ে আসছে।
সূত্র আরো জানায়, দেশীয় ব্যাংকগুলোর আগ্রাসী ব্যাংকিংয়ের কারণে বর্তমানে প্রতিটি ব্যাংকেরই চরম অর্থসঙ্কট চলছে। এ অবস্থায় টাকার সঙ্কট মেটাতে উচ্চ সুদে আমানত সংগ্রহ শুরু করেছে। গড়ে প্রায় প্রতিটি ব্যাংকই এখন ডাবল ডিজিটে আমানত সংগ্রহ করছে। কোনো কোনো ব্যাংক ১৪ শতাংশ পর্যন্ত সুদে আমানত নিচ্ছে। উচ্চ সুদে আমানত নেয়ায় স্বাভাবিকভাবেই ঋণের সুদহার বেড়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে কিছু কিছু উদ্যোক্তা আবারো বিদেশী ঋণ নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। ইতোমধ্যে তারা বাংলাদেশ ব্যাংকে যোগাযোগ শুরু করেছে। তারা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে প্রস্তাব পাঠাচ্ছে।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিদেশী ওসব ঋণের সুদ আপাতত কম মনে হলেও কার্যকরী সুদহার আরো বেড়ে যাবে। যেমন একজন বিনিয়োগকারী বিদেশ থেকে সাড়ে ৬ শতাংশ হারে ১০০ কোটি ডলার (৮৪ টাকা প্রতি ডলার হিসেবে) ঋণ গ্রহণ করল। এক বছর পর প্রতি ডলার ৯০ টাকা হলে প্রতি ডলারে টাকার মান কমে প্রায় ৭ শতাংশ। ডলারে ঋণ করে টাকায় ব্যয় করলেও ডলারে পরিশোধ করায় বিনিময় হারের কারণে সুদ ব্যয় বেড়ে হবে (৬.৫+৭) সাড়ে ১৩ শতাংশ। এভাবে কেউ ৫ বা ১০ বছর মেয়াদি বিদেশী ঋণ নিলে কার্যকরী হার অনেক বেড়ে যাবে। যেমন ২০১৬ সালে প্রতি ডলার ছিল ৭৯ টাকা, বর্তমানে যা আমদানি পর্যায়ে ৮৫ টাকায় উঠে গেছে। বিগত ২০১১ সালে ৯২ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন দেয়া হয়েছিল। পরের বছর অর্থাৎ ২০১২ সালে ১৪৯ কোটি টাকার ঋণ নেয়ার অনুমোদন দেয়া হয়। তার পর প্রতিবছরই তা বাড়তে থাকে। এর সাথে যোগ হয় অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বৈদেশিক ঋণ। অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ব্যাংকগুলো ব্যবসায়ীদের বৈদেশিক ঋণের জোগান দিয়ে আসছে। অর্থাৎ ব্যাংক বিদেশী কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ নিয়ে ওই ঋণ আবার ব্যবসায়ীদের মাঝে বিতরণ করছে। ফলে বেসরকারি পর্যায়ে প্রকল্প ঋণ ও অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বৈদেশিক ঋণ বেড়ে যাচ্ছে।
অন্যদিকে ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ব্যাংকগুলোর হাতে পর্যাপ্ত অলস টাকা রয়েছে। ব্যবসায়ীরা স্থানীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে তা থেকে যে সুদ পরিশোধ করতো তা দেশেই থেকে যেতো। তাতে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদের ওপর কোনো চাপ বাড়তো না। তাতে ব্যাংকগুলোরও তহবিল ব্যয় কমতো। যার সামগ্রিক প্রভাব দেশের অর্থনীতিতে পড়তো। কিন্তু এখন ব্যবসায়ীরা বিদেশী ঋণ নেয়ায় বৈদেশিক মুদ্রায় সুদ পরিশোধ করছে। তাতে ওসব ঋণের সুদ বৈদেশিক মুদ্রায় বিদেশে চলে যাচ্ছে। এ ব্যয় বেড়ে গেলে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদের ওপর পড়বে। ইতোমধ্যে রফতানি আয় কমে যাওয়ায় ও আমদানি ব্যয় তুলনামূলক বেশি বেড়ে যাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ কমতে শুরু করেছে। বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ বাড়তে থাকলে রিজার্ভের ওপর চাপ আরো বেড়ে যাবে, যা অর্থনীতির জন্য মোটেও কল্যাণকর হবে না।

এফএন/এমআর

বাংলাদেশ সময়: ১৯:৫৮:৫৮ ● ৩৩৩ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ