ভুয়া সাংবাদিকতার দাপট: গণমাধ্যমে আস্থার সংকট

হোম পেজ » মুক্তমত » ভুয়া সাংবাদিকতার দাপট: গণমাধ্যমে আস্থার সংকট
শুক্রবার ● ১২ ডিসেম্বর ২০২৫


 

প্রতীকী চিত্র

মোঃ রোকনুজ্জামান শরীফ

বাংলাদেশের গণমাধ্যম খাত আজ এক গভীর সঙ্কটের মুখোমুখি- ভুয়া সাংবাদিকতার বিস্তার। প্রযুক্তির সহজলভ্যতা, অনলাইন প্ল্যাটফর্মের অগণিত বিস্তার এবং আইন প্রয়োগের দুর্বলতার সুযোগে এমন এক শ্রেণি তৈরি হয়েছে, যারা সাংবাদিকতার মহৎ পেশাকে ব্যবহার করছে ব্যক্তিগত স্বার্থ, চাঁদাবাজি ও প্রতারণার হাতিয়ার হিসেবে। এর ফলে প্রকৃত সাংবাদিকদের মর্যাদা, দায়িত্বশীলতা এবং গণমাধ্যমের সামগ্রিক বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে।

 

ভুয়া সাংবাদিকতার বিস্তারের বাস্তব চিত্র

গত দশকে অনলাইন সংবাদমাধ্যমের সংখ্যা কয়েক হাজারে পৌঁছেছে। এর মধ্যে নিবন্ধিত পোর্টালের সংখ্যা খুবই কম, আর নামসর্বস্ব পোর্টালের সংখ্যা অঢেল। এই সুবিধা নিয়েই গজিয়ে উঠছে ‘মাইক্রোফোন সাংবাদিক’ ও ‘আইডি কার্ড রিপোর্টার’ নামে নতুন গোষ্ঠী।

বাজার, পরিবহন এলাকা, শিল্পাঞ্চল বা দুর্ঘটনাস্থলে গিয়ে ভয়ভীতি দেখানো, ভিডিও করার হুমকি দিয়ে টাকা আদায়, ব্যবসায়ীদের ব্ল্যাকমেইল করা এদের সাধারণ কাজ।

অনেকে আবার সামাজিক মাধ্যমে ক্লিকবেইট ভিডিও, মিথ্যা লাইভ, গুজব বা উত্তেজনাপূর্ণ বক্তব্য ছড়িয়ে নিজেদের ‘রিপোর্টার’ হিসেবে তুলে ধরছে।

রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় সক্ষম হয়ে কিছু অপেশাদার ব্যক্তি সহজেই সংগঠনের কার্ড সংগ্রহ করে ক্ষমতা ও পরিচয় অপব্যবহার করছে।

 

কেন ভুয়া সাংবাদিকতা বাড়ছে

অনলাইন মিডিয়া স্থাপন এখন সহজ, সস্তা এবং প্রায় কোনও যাচাই-বাছাই ছাড়াই সম্ভব। ফলে পেশাদার নীতিমালা ও সম্পাদকীয় মান না মেনে যে কেউ প্রতিষ্ঠাতা বা সম্পাদক পরিচয় ব্যবহার করতে পারছে।

সরকারি পর্যায়ে নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত পোর্টালের তালিকা হালনাগাদ নয়। মাঠপর্যায়ের প্রশাসনের কাছে তথ্য না থাকায় বেনামি ‘রিপোর্টার’রা অবাধে কাজ করতে পারে।

একেক জেলায় একাধিক প্রেসক্লাব, সংগঠন বা ইউনিটির জন্ম হয়েছে; কোথাও কোথাও সদস্যপদ বাণিজ্যও চলছে।

সাংবাদিক পরিচয় ব্যবহার করে চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে আইন থাকলেও এর প্রয়োগ সীমিত। অভিযোগ কম হয়, বিচার হয় আরও কম।

 

ক্ষতিকর প্রভাব

প্রকৃত সাংবাদিকরা মাঠে গিয়ে অনেক সময় সন্দেহ, অবিশ্বাস ও অসৌজন্যমূলক আচরণের মুখে পড়েন। ভুয়া সাংবাদিকদের আগ্রাসী আচরণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করেছে।

গণমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অল্প কিছু ভুয়া ব্যক্তির কর্মকাণ্ডের কারণে সত্যিকারের সংবাদমাধ্যমও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।

গুজব, মিথ্যা ব্রেকিং নিউজ এবং উত্তেজনাপূর্ণ ভিডিও সমাজে বিভ্রান্তি তৈরি করে, কখনো অস্থিরতাও বাড়ায়।

প্রশাসন–গণমাধ্যম সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্র সংকুচিত হচ্ছে।

এ কারণে অনেক শিক্ষিত, প্রশিক্ষিত তরুণ সাংবাদিকতা পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।

 

সমাধানের পথ

প্রত্যেক অনলাইন নিউজ পোর্টালের বাধ্যতামূলক নিবন্ধন এবং বার্ষিক রিনিউয়াল কার্যকর করা জরুরি। সম্পাদকীয় নীতিমালার সুনির্দিষ্ট কপি জমা দেওয়ার বিধান থাকতে হবে।

সরকার অনুমোদিত একটি একক প্রেস কার্ড চালু করা দরকার। বিভিন্ন সংগঠন, ক্লাব বা অনলাইন পোর্টালের পৃথক আইডি মাঠপর্যায়ে বৈধ পরিচয় হিসেবে গ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে হবে।

চাঁদাবাজি, পরিচয় অপব্যবহার বা ভিডিও হুমকির মতো অপরাধ দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে নেওয়ার ব্যবস্থা করলে অপব্যবহার কমবে।

প্রেস কাউন্সিল, তথ্য মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সমন্বয়ে মিডিয়া পর্যবেক্ষণের জন্য একটি শক্তিশালী ইউনিট গঠন করতে হবে।

প্রতিটি মিডিয়া হাউসকে নতুন সাংবাদিকদের নৈতিকতা, ফ্যাক্ট-চেকিং, রিপোর্টিং কৌশল এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা বিষয়ে বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে।

সাধারণ জনগণ, ব্যবসায়ী ও প্রশাসনকে সচেতন করতে হবে-মাইক্রোফোন হাতে পেলেই কেউ সাংবাদিক হয়ে যায় না; পরিচয় ও নিবন্ধন যাচাই অপরিহার্য।

 

শেষকথা

ভুয়া সাংবাদিকতার অবাধ বিচরণ কেবল একটি পেশার মর্যাদাহানি নয়; এটি দেশের তথ্যব্যবস্থা, গণতন্ত্র এবং জনগণের আস্থার উপর সরাসরি আঘাত। সাংবাদিকতা সত্য অনুসন্ধানের পেশা-সুবিধা আদায়ের মাধ্যম নয়। প্রকৃত সাংবাদিকদের সম্মান ফিরিয়ে আনতে এখনই প্রয়োজন কঠোর পদক্ষেপ, শক্তিশালী মনিটরিং এবং সমাজের সক্রিয় ভূমিকা। আজ ব্যবস্থা না নিলে আগামী দিনে সত্য সংবাদ পাওয়াই কঠিন হয়ে পড়বে।

 

লেখক:

সাধারণ সম্পাদক, মঠবাড়িয়া প্রেসক্লাব

পিরোজপুর

বাংলাদেশ সময়: ১৪:১৩:০৯ ● ৩০ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ