
সাগরকন্যা প্রতিবেদন, বরগুনা
বরগুনা জেলা শহরের শিল্পকলা একাডেমিতে অবস্থিত একমাত্র মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরটি লুটের পর এখন অবহেলা ও অযত্নে ফাঁকা পড়ে আছে। কবে নাগাদ এটি সংস্কার হবে, তা কেউ জানে না। বিজয় দিবসে সবার জন্য উন্মুক্ত থাকা এই জাদুঘরে এখন দেখভালের কেউ নেই। পুরো জাদুঘরটি যেন অভিভাবকহীন পরিত্যক্ত স্থাপনা। লুট হওয়া সামগ্রী ফেরত চাওয়ার আহ্বান জানিয়েও কোনো ফল পাওয়া যায়নি বলেও জানা গেছে।
জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধ ও ইতিহাসভিত্তিক তিন শতাধিক আলোকচিত্র, বই, স্মরণিকা, মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত কাঠের তৈরি ভাঙা বন্দুক, পোশাক, রান্নার পাতিলসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র সংরক্ষিত ছিল বরগুনার এই একমাত্র মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে। পাশাপাশি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মাধ্যমে সংরক্ষিত বরগুনায় স্থাপিত মোগল আমলের ঐতিহাসিক শাহি মসজিদের অংশ এবং পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জের ঐতিহাসিক মজিদ বাড়িয়া মসজিদের ইট-পাথরের অংশ এখানে রাখা ছিল।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার উৎখাত হওয়ার পর এই জাদুঘরে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ছড়িয়ে দিতে ১৯৯৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ও ইতিহাসভিত্তিক বেশ কিছু আলোকচিত্র সংগ্রহ করে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রদর্শন শুরু করা হয়। পরবর্তীতে এটি জেলা প্রশাসনের জাতীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। ২০১৩ সালে জেলা শিল্পকলা একাডেমির নিচতলার একটি কক্ষে মুক্তিযুদ্ধ গ্যালারির কার্যক্রম শুরু হয়। ২০১৮ সালে প্রাতিষ্ঠানিক রূপে গ্যালারি চালু হয় এবং ২০১৯ সালের ৩০ নভেম্বর তৎকালীন বরগুনার জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ এটি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর হিসেবে রূপান্তর করেন। এরপর থেকে বিভিন্ন জাতীয় দিবসে শিক্ষার্থী ও দর্শনার্থীরা নিয়মিত জাদুঘরটি পরিদর্শন করতেন।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক কর্মী চিত্তরঞ্জন শীল জানান, ১৯৮৫ বা ১৯৮৬ সালের দিকে স্থানীয় কয়েকজন সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক কর্মী জেলার মুক্তিযুদ্ধ ও প্রত্নতাত্ত্বিক কিছু ছবি সংগ্রহ করে আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। পরে সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন, স্থানীয় প্রশাসন, রোভার স্কাউট ও রেড ক্রিসেন্ট সদস্যরা এতে সহযোগিতা করেন। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়েও বরগুনার এই উদ্যোগে সহায়তা করেছে। ধীরে ধীরে এ উদ্যোগ জাতীয় দিবসের কর্মসূচির অংশ হয়ে ওঠে।
তিনি আরও জানান, জাদুঘরে মুক্তিযুদ্ধ ছাড়াও স্থানীয় নানা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, বিভিন্ন বই এবং প্রদর্শনযোগ্য দলিলপত্র সংরক্ষিত ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুসলিম লীগ, ন্যাপ, আওয়ামী কমিউনিস্ট পার্টি, জামায়াত, কৃষক প্রজা পার্টি, নেজামে ইসলামীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ডের দলিলপত্রও এখানে ছিল। এছাড়া ছিল ইতিহাসভিত্তিক দুষ্প্রাপ্য আলোকচিত্র। জাদুঘরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবির পাশাপাশি সেক্টর কমান্ডার ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ছবিও সংরক্ষিত ছিল। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের মধ্যে বেতাগী শাহি মসজিদ ও মজিদ বাড়িয়ার মসজিদের ইট, ছবি, বেতাগী কাউনিয়ার পার্বতী রঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের নির্মিত ঐতিহাসিক মন্দিরের স্মৃতিচিহ্ন, পুরোনো রেডিও ও টেলিভিশন ছিল। তালতলীর জয়াল ভাঙ্গায় ১৯৯০ সালে উদ্ধার হওয়া ৪৮ ফুট দৈর্ঘ্যের তিমি মাছের হাড় এবং বিভিন্ন দেশের হাজারের বেশি ধাতব ও কাগুজে মুদ্রাও সংরক্ষিত ছিল।
হামলার দিনের বর্ণনা দিতে স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হামলাকারীরা কক্ষের প্রতিটি কাচঘেরা টেবিল ও সংরক্ষিত উপকরণ ভেঙে ফেলে। অনেক উপকরণ লুট করে নিয়ে যায়। বেশ কিছু বই ও দলিলপত্র বাইরে নিয়ে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলা হয়। জাদুঘরে ব্যবহৃত মাইকও ভাঙচুর করা হয়। অবশিষ্ট জিনিসপত্রও যেভাবে পেরেছে নিয়ে গেছে বলে জানান তারা। ওই সময় লুটপাটে কেউ বাধা দেয়নি।
৫ আগস্টের তিন দিন পর ঘটনাস্থলে যায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি দল। ভয়াবহ দৃশ্য দেখে তারা সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়। তবে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত লুট হওয়া সামগ্রী ফেরত আসেনি।
বরগুনা জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের আহ্বায়ক ইউসুফ মৃধা বলেন, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরটি নতুন প্রজন্মের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জেলা প্রশাসনের কাছে অনুরোধ- জাদুঘরটি দ্রুত সংস্কার করে লুট হওয়া দলিলপত্র উদ্ধারের ব্যবস্থা করা হোক।
এ বিষয়ে বরগুনার জেলা প্রশাসক মিজ তাছলিমা আক্তারের হোয়াটসঅ্যাপে বুধবার দুপুরে খুদে বার্তা পাঠিয়ে জানতে চাওয়া হয়- বরগুনার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ৫ আগস্ট ভেঙে ফেলেছে স্থানীয় জনগণ; কবে নাগাদ এর সংস্কার কাজ শুরু হতে পারে? সামনে ১৬ ডিসেম্বর। তিনি বার্তাটি দেখলেও তিন দিনেও কোনো জবাব দেননি।