সংসদ নির্বাচন পরবর্তী রাজনৈতিক হালচাল

প্রথম পাতা » মুক্তমত » সংসদ নির্বাচন পরবর্তী রাজনৈতিক হালচাল
বৃহস্পতিবার ● ৭ ফেব্রুয়ারী ২০১৯


বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী
৩০ ডিসেম্বর ২০১৮ একাদশ সংসদ নির্বাচনি শেষ হয়েছে। সংসদ সদস্যরা শপথগ্রহণ করেছেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মন্ত্রিসভাও গঠিত হয়েছে। মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়েছে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যদের নিয়ে। ১৪ দলের এবার কাউকে মন্ত্রিসভায় নেওয়া হয়নি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সব দলের অংশগ্রহণে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হওয়ার কথা বলেছেন। আবার দেশে ও বিদেশে কেউ কেউ নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে বলেও উল্লেখ করেছেন। এমনকি ১৪ দলের শরিক দল জাসদও (আম্বিয়া কারচুপির কথা বলেছেন। এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে তাদের কার্যকরী সভাপতি, যিনি নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে জিতেছেন, তার সংসদ সদস্যপদ থেকে পদত্যাগ করা উচিত ছিল। সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলার যাদের সৎ সাহস থাকে তাদের পদক্ষেপও অনুরূপ হওয়া উচিত।
যাহোক, সমগ্র বিশ্বে এখন রাজনীতি ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে। স্বর্গরাজ্য প্রতিষ্ঠা এখন আর সম্ভব নয়। স্বর্গরাজ্য প্রতিষ্ঠা হবে বলে কেউ যদি মনে করেন, তবে ধরে নিতে হবে তার শাসক হবে সিজারেরা। ট্রাম্প নাকি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন রাশিয়ার সাইবার কারসাজিতে। ব্যাপক তদন্ত চলছে, অনেকে জেলেও আছেন। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও কারচুপির অভিযোগ উঠেছিলো।
অবশ্য নির্বাচন যতটুকু সম্ভব কারচুপিমুক্ত হওয়াই উচিত। রাশিয়ার শাসনতন্ত্রে আছে দুইয়ের অধিকবার কেউ এক পদে নির্বাচন করতে পারবেন না। ভøাদিমির পুতিন এযাবৎ দুইবার প্রধানমন্ত্রী পদে নির্বাচন করেছেন, আবার দুইবার প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হয়েছেন। আর কতবার এভাবে নির্বাচন করেন জানি না। অবশ্য পুতিন খুবই উপযুক্ত লোক। বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়া রাশিয়াকে পুনর্গঠিত করে একক পরাশক্তি আমেরিকার পাশে রাশিয়াকে আবার পরাশক্তি হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং আমেরিকার বাণিজ্য অবরোধের কারণে পরিপূর্ণ শক্তি অর্জন সম্ভব না হলেও আমেরিকার একতরফা কর্তৃত্বের হাত থেকে বিশ্বকে রক্ষা করেছেন।
১৯৯১ সাল থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে মূলত আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিই ছিল মূল প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান আওয়ামী বিরোধী সব শক্তিকে একত্র করে বিএনপি গঠন করেছিলেন। এই কাজে তাকে সহযোগিতা করেছিলেন মশিউর রহমান, শাহ আজিজ, বিচারপতি সাত্তার, মীর্জা গোলাম হাফিজ, আবদুর রহমান বিশ্বাস, আবদুল হালিম, মেজর জেনারেল মাজেদুল হক, কে.এম. ওবায়দুর রহমান, আবদুস সালাম তালুকদার, আবদুল মান্নান ভূঁইয়া, কর্নেল মোস্তাফিজুর রহমান প্রমুখ। এখন এসব নেতার মৃত্যু হয়েছে। বিএনপি নেতৃত্ব শূন্যতার মাঝে পড়েছে। দ্বিতীয় পর্যায়ের নেতারাই এখন নেতৃত্বে এসেছেন।
২০০১ সালে বিএনপি যখন ক্ষমতায় আসে তখন এ দ্বিতীয় পর্যায়ের নেতারাই মূলত নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তাদের বিরুদ্ধে বর্তমানে অসংখ্য দুর্নীতির মামলা রয়েছে। ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দিন সরকারের সময়ই এসব দুর্নীতির মামলা হয়। বর্তমানে যে দুই মামলায় শাস্তি পেয়ে বেগম জিয়া কারাভোগ করছেন সে দুই মামলাও ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দিন সরকারের করা মামলা। এখন বিএনপির মূল নেতৃত্ব বেগম জিয়া এবং তারেক রহমানের হাতে। তারা দুইজনই অনুপস্থিত। বেগম জিয়ার ১৭ বছরের কারাদ- হয়েছে। তিনি গত এক বছর ধরে কারাগারে আছেন আর তারেক রহমান লন্ডনে ব্রিটিশ সরকারের রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে বসবাস করছেন। বেগম জিয়ার সঙ্গে তারেকের এক মামলায় ৭ বছরের জেল হয়েছে এবং ম্যানি লন্ডারিং মামলায় তার ১০ বছরের জেল হয়েছে। সিঙ্গাপুরের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে পাচার করা টাকাও আওয়ামী লীগ সরকার ফেরত এনেছেন।
নেতৃত্বের অভাবে বিএনপি এখন পাকিস্তানিদের পরিত্যক্ত সম্পত্তির রূপ নিয়েছে। বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির কোষাধ্যক্ষ ছিলেন তানভীর আহাম্মদ সিদ্দিকী। তার হাতে বিএনপির ক্রয় করা পল্টনের অফিসের দলিল দস্তাবেজ ছিল। তিনি তার প্রয়োজনে এসব দলিল দস্তাবেজ ব্যাংক বন্ধক দিয়ে ঋণ নিয়েছেন। এ কারণে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। গত ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য তার বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহার করে গাজীপুরের কাপাসিয়া কেন্দ্র থেকে তাকে মনোনয়ন প্রদান করেছিলো দল। তিনি মরহুম তাজউদ্দীন সাহেবের মেয়ে রিমির হাতে পরাজিত হয়েছেন।
এবারের নির্বাচনে নেতৃত্বশূন্যতা কাটানোর জন্য আর ভাবমূর্তিসম্পন্ন কোনও নেতা নেই অনুরূপ অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য বিএনপি ড. কামাল হোসেনকে নেতা মেনে ঐক্যফ্রন্ট গঠন করেছিলো। কিন্তু ড. কামাল হোসেন নিজে নির্বাচন না করায় তারা সেই বেনিফিট পায়নি। না হয় ড. কামাল হোসেনের বড় বড় কথায় বিএনপি কর্মীরা এবং আওয়ামী লীগ বিরোধী শক্তি কিছুটা চাঙ্গা হয়েছিলো। সর্বোপরি বিএনপিতে এত ব্যাপকভাবে মনোনয়ন বাণিজ্য হয়েছে যে নির্বাচনের আগেও তাদের ভাবমূর্তি ভূলুণ্ঠিত হয়ে পড়েছিলো। সুতরাং ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিএনপির পরাজয় অবধারিত ছিল।
ড. কামাল হোসেন বিএনপির অচল নেতাদের সঙ্গে ঐক্য করে নিজের ভাবমূর্তিটাই ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন। তিনি সৎ রাজনীতিবিদ। তার আইন ব্যবসায় আন্তর্জাতিক খ্যাতিও রয়েছে। তার দল ক্ষুদ্র হলেও তিনি কিন্তু বড় নেতা ছিলেন। তার উচিত ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি এম, আর কায়ানী যেমন অবসরে গিয়ে আইয়ুবের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিটি বার অ্যাড্রেস করেছিলেন, পূর্ব-পাকিস্তানে আসার পর তিনি চট্টগ্রাম থেকে বার অ্যাড্রেস করতে মনস্থ করেছিলেন, দুর্ভাগ্য যে তিনি চট্টগ্রামে পৌঁছেই হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। আমরা দেখেছি মরহুম বিচারপতি কায়ানী যদিওবা বার অ্যাড্রেস করেছিলেন কিন্তু তার প্রতিক্রিয়া জনসাধারণের মাঝে অভাবনীয়ভাবে পড়েছিলো।
বিচারপতি কায়ানী পত্রিকায় ‘নট হোল দ্য ট্রুথ’ নামে কলামও লিখতেন। পরবর্তী সময়ে তা বই আকারে প্রকাশিত হয়েছিলো। ড. কামালের জন্য মানানসই কাজ ছিল অনুরূপ কিছু। অচল মুদ্রার সঙ্গে গিয়ে তিনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কারচুপি হোক বা কারচুপি না হোক একটা সংসদ প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একটা সরকারও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এখন আওয়ামী লীগ একটা শক্তিশালী দল। সুতরাং এই সংসদ, এই সরকারকে বিতাড়িত করা খুব সহজ কাজ নয়।
বিএনপির এখন খুবই করুণ অবস্থা। এখন আপসহীন অবস্থায় থাকা তার জন্য কখনও বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। তাদের উচিত হবে সংসদে যোগদান করা। গণফোরামের সুলতান মোহাম্মদ মনসুর ও মোকাব্বেরকে রাখা যাবে না। তারা শেষ পর্যন্ত সংসদে যোগদান করবেন বলে আমার দৃঢ় ধারণা। সুতরাং বিএনপির ৬ জন সদস্য শপৎ না নিলে বা সংসদে না গেলে সংসদ অসম্পূর্ণ থাকবে না বরং বিএনপি বৈরিতা পরিহার করে সংসদে যোগদান করলে তাদেরই লাভ হবে। গণতন্ত্র শক্তিশালী হবে।
প্রধানমন্ত্রী নিজেই তাদের সংসদে যোগদানের জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। মানুষ যা করুক না কেন মানসিক অভ্যাসকে অতিক্রম করতে পারে না। ড. কামালকেও তারা বেশি দিন ধরে রাখতে পারবেন না। কারণ ড. কামালের মানসিক বিকাশ আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিলে, বিএনপির সঙ্গে নয়। এখনই ড. কামালের বিরুদ্ধে বিএনপির নেতাকর্মীরা কথা বলা আরম্ভ করেছেন।
নির্বাচন বামপন্থী দলগুলোও মেনে নেয়নি। তারাও এখন বিভিন্ন কর্মসূচি আরম্ভ করেছেন। তবে তারা জন্মের পর থেকে গত এক শতাব্দীব্যাপী বীজাগারে রয়ে গেল ডালপালা মেলে বৃক্ষ হতে পারলো না। এখন তাদেরও উচিত হবে জনবান্ধব কর্মসূচি নিয়ে অগ্রসর হওয়া।
ডাকসুর নির্বাচন হবে ক’দিন পর। ছাত্রলীগের প্যানেল যেন পাস করে সেভাবে ছাত্রলীগ কর্মীরা যেন কাজ করা দরকার। কারণ, ডাকসু হাতছাড়া হলে ক্ষণে ক্ষণে ছাত্রদের সঙ্গে সরকারের সংঘাত হবে, যা স্থিতিশীল সরকারের জন্য কাম্য নয়। সরকার স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় প্রতীকে করায় স্থানীয় সরকারে যোগ্য এবং জনপ্রিয় লোকেরা নির্বাচিত হতে পারছেন না। প্রার্থিতা দলীয় মার্কায় হওয়ায় দল যাকে দিচ্ছে তাকেই ভোট দিতে অনেকটা বাধ্য করা হচ্ছে কিন্তু মার্কার সীমাবদ্ধতা না থাকলে মানুষ যোগ্য লোকটিকে নির্বাচিত করার বেশি সুযোগ ছিল।
শুনেছি ভাইস প্রেসিডেন্টের দুটি পদেই দলীয় প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হবে না, শুধু চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রতীক দেওয়া হবে। বিএনপি, বাম এবং ইসলামি আন্দোলন এই নির্বাচনে যাবে না ঘোষণা দিয়েছে। ফলে ভোটযুদ্ধ এখন আওয়ামী লীগের নিজেদের মধ্যেই হবে। আমি মনে করি উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদেও দলীয় মার্কা ছাড়া হওয়া বাঞ্ছনীয়। আর ঢাকা দক্ষিণের মেয়র নির্বাচনসহ উপজেলা নির্বাচনকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখত হবে।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

বাংলাদেশ সময়: ১১:৩৯:১৭ ● ৬৪৫ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ