ঝালকাঠিতে ভাসমান পেয়ারার হাট পর্যটকে মুখরিত

প্রথম পাতা » ঝালকাঠী » ঝালকাঠিতে ভাসমান পেয়ারার হাট পর্যটকে মুখরিত
শুক্রবার ● ১১ আগস্ট ২০২৩


ঝালকাঠিতে ভাসমান পেয়ারার হাট পর্যটকে মুখরিত

ঝালকাঠি সাগরকন্যা প্রতিনিধি॥

বাংলাদেশের একমাত্র ভাসমান পেয়ারার হাট ঝালকাঠির ভীমরুলী এখন পর্যটকে মুখরিত। পদ্মা সেতুর চালু হওয়ায় বিগত বছরগুলোর তুলনায় এ বছর পেয়ারা দাম বেশি পেলেও প্রচন্ড তাপদাহ ও অনাবৃষ্টির কারণে ফলন কম হওয়ায় হতাশ কৃষকরা।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, ঝালকাঠি, বানারীপাড়া ও স্বরূপকাঠি উপজেলার ৫৫ গ্রামের পেয়ারা বাগানকে ঘিরে ভাসমান পেয়ারার হাট পর্যটকে মুখরিত হয়ে উঠেছে। ঘুরতে আসা আশিক, তুহিন ও রাসেল জানান, পদ্মা সেতুর কারনে দ্রত সময়ে দেশ বিদেশের ভ্রমণ পিপাসুরা এ হাটে এসে হৈ হুল্লোরে মেতে উঠেছেন। পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে গড়ে উঠেছে পার্ক ও খাবার দোকানসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এই এলাকার হাজার হাজার মানুষের কাছে ‘পেয়ারা’ অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য ও জীবিকার অবলম্বন। পেয়ারা চাষী ভবেন হালদার, নিশিত হালদার, বিধান রায় জানান, আষাঢ়-শ্রাবণের ভরা বর্ষায় এসব এলাকার নদী-খালজুড়ে পেয়ারার সমারোহ। পদ্মা সেতুর কারণে পেয়ারা বাজার ভালো হলেও বৃষ্টি না হওয়ায় ও তাপদাহে পেয়ারার ফলন কম হয়েছে। এতে চাষীরা খরচও তুলতে পারবেন না বলে হতাশা প্রকাশ করেছে।
কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, ঝালকাঠি সদর উপজেলার ১৩গ্রামে ৩৫০হেক্টর জমিতে, বরিশাল জেলার বানারীপাড়া উপজেলার ১৬গ্রামে ৯৩৭হেক্টর, পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি উপজেলার ২৬গ্রামের ৬৪৫হেক্টর জমিতে পেয়ারা চাষ হয়। চাষীরা জানান, আবহাওয়ার বিরূপ প্রভাবে অর্ধেকেরও কম ফলন হয়েছে। পেয়ারা গাছে যে পরিমাণ ফুল এসেছিলো এবছর বৃষ্টিপাত না হওয়ায় তা অনেকটাই ঝড়ে গেছে। গাছ পুড়ে গেছে এমন মনে হয়। পেয়ারা বাজার ভাল হলেও লাভবান হতে পারবেন না বলে জানান চাষীরা।
এদিকে দেশ বিদেশের বিভিন্ন স্থানের প্রকৃতি প্রেমীরা প্রাকৃতিক নৈসর্গ উপভোগ করার জন্য ভীড় জমাচ্ছেন পেয়ারা রাজ্যে। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার সুবাদে সড়কপথে সকালের পেয়ারা বিকেলের মধ্যেই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে যায়। ভাসমান পেয়ারা বাজার বিখ্যাত থাকলেও পেয়ারা রাজ্যের সবচেয়ে বড় মোকাম ভীমরুলীতে। সেখানে প্রবেশের পথে পথে রাস্তার পাশের খালেই নৌকায় পেয়ারার পসরা নিয়ে পাইকারদের কাছে তুলে দিচ্ছেন বিক্রেতারা। প্রতি মণ পেয়ারার দাম আকার ও রং ভেদে ৩০০ থেকে ৪৫০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করছেন তারা। ভাসমান হাট হিসেবে বিখ্যাত হলেও ভীমরুলীর বড় মোকাম ডিঙি নৌকায় করে পেয়ারা নিয়ে আগের চেয়ে আনাগোনা কম। ঝালকাঠি শহর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরত্বের সড়কের পাশে ১০টিরও বেশি মোকামে পেয়ারা কেনাবেচা হচ্ছে। পেয়ারার দাম প্রতি বছরের চেয়ে ভালো পেলেও ফলন কম হওয়ায় কৃষকের আনন্দ নিরানন্দই থেকে যাচ্ছে। আষাঢ়-শ্রাবণের ভরা বর্ষায় এ অঞ্চলের নদী-খালের পাড়ে সজ্জন পদ্ধতিতে সৃজিত পেয়ারা গাছে ঝোলে সবুজ ফল। আষাঢ়ে পেয়ারা পাকার মৌসুম হলেও শ্রাবণের শুরুতে পেয়ারা পরিপক্ক হওয়ায় এখন জমে উঠেছে পেয়ারার হাট। ভিমরুলী, শতদলকাঠী, খাজুরিয়া, ডুমুরিয়া, কাপুড়াকাঠী, জগদীশপুর এলাকা ঘুরে কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। বরিশাল বিভাগের কম-বেশি সব জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পেয়ারার চাষ হলেও বরিশাল জেলার বানারিপাড়া, ঝালকাঠি সদর ও পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি ঘিরেই মূলত পেয়ারার বাণিজ্যিক চাষ। এসব এলাকার মধ্যে ঝালকাঠির কীর্ত্তিপাশা, ভিমরুলী, শতদলকাঠী, খাজুরিয়া, ডুমুরিয়া, কাপুড়াকাঠি, জগদীশপুর, মীরকাঠি, শাখা গাছির, হিমানন্দকাঠি, আদাকাঠি, রামপুর, শিমুলেশ্বর গ্রামে বড় অংশজুড়ে বাণিজ্যিকভাবে যুগ যুগ ধরে পেয়ারার চাষ হচ্ছে। স্বরূপকাঠির ২৬গ্রামের মধ্যে আছে সঙ্গীতকাঠি, খায়েরকাঠি, ভদ্রানন্দ, বাচ্চুকাঠি, ভাংগুরা, আদাবাড়ি, রাজাপুর, ব্রাহ্মণকাঠি, ধলহার, জিন্দাকাঠি, আটঘর, কুড়িয়ানা, পূর্ব জলাবাড়ি, ইদিলকাঠি, আরামকাঠি, মাদ্রা, গণপতিকাঠি, আতাকাঠি, জামুয়া, জৈলশার, সোহাগদল, আদমকাঠি, অশ্বত্থকাঠি, সমীত, সেহাংগল, আন্দারকুল। বরিশালের বানারিপাড়ার পেয়ারা বাগানগুলো হলো তেতলা, সৈয়দকাঠি, মালিকান্দা, ব্রাহ্মণবাড়ি, বোয়ালিয়া, জম্বুদ্বীপ, বিশারকান্দি, মরিচবুনিয়া, মুরার বাড়ি, উমরের পাড়, লবণ সড়া, ইন্দির হাওলা, নরেরকাঠি, রাজ্জাকপুর, হলতা, চুয়ারিপাড়। এসব গ্রামের কয়েক হাজার কর্মজীবী পরিবার যুগ যুগ ধরে পেয়ারার চাষ করছেন। পেয়ারার চাষ, ব্যবসা ও বাজারজাতকরণেও রয়েছে কয়েক হাজার মৌসুমি বেপারি এবং শ্রমিক। এ সময় অন্তত কুড়িটি স্থানে পেয়ারার মৌসুমি মোকামের সৃষ্টি হয়। এরমধ্যে আবার সড়কপথেও ১০টিরও বেশি মোকামে বেচাকেনা হচ্ছে। এগুলো হলো ভিমরুলী, আতাকাঠী, ডুমুরিয়া, গণপতিকাঠী, শতদলকাঠী, রাজাপুর, মাদ্রা, আদমকাঠি, জিন্দাকাঠি, বর্ণপতিকাঠি, আটঘর, কুড়িয়ানা, আন্দাকুল, রায়ের হাট, ব্রাহ্মণকাঠি, ধলহার, বাউকাঠি। এসব মোকামে মৌসুমে প্রতিদিন ৫ থেকে ৭ হাজার মণ পেয়ারা কেনাবেচা হয়ে থাকে।

---

স্থানীয় চাষিরা জানান, আনুমানিক ২০০ বছরেরও বেশি সময় আগে বিচ্ছিন্ন আবাদ হলেও ১৯৪০ সাল থেকে শুরু হয়েছে পেয়ারার বাণিজ্যিক আবাদ। এ আবাদ ক্রমশ বাড়ছে। ২০২২ সালে অন্তত ১৯৩২ হেক্টর জমিতে বাণিজ্যিক পেয়ারার আবাদ হয়েছে। এ সময় ফলন হয়েছে প্রায় ২০ হাজার মেট্রিক টন। কিন্তু এ বছর ফলন কম হওয়ায় শেষ পর্যন্ত ১০ হাজার মেট্রিক টন পেয়ারা উৎপাদন হবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে বলে হতাশা প্রকাশ করেন পেয়ারা চাষিরা। কৃষক পঙ্কজ বড়াল বলেন, ‘মাঘ-ফাল্গুন মাসে পেয়ারা গাছের গোড়া পরিষ্কার করে সার প্রয়োগ করতে হয়েছে। এরপরে কাদা মাটি দিয়ে গোড়া ঢেকে দিয়েছি। তাতে প্রতিটা গাছের গোড়ায় গড়ে তিন শতাধিক টাকা ব্যয় হয়েছে। পেয়ারা গাছে যে পরিমাণ ফুল এসেছিল, বৃষ্টি না হওয়ায় তা অনেকটাই ঝরে গেছে। লাভ তো দূরের কথা, আসল খরচের টাকাই ওঠে কি না তাই নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।’ কৃষক দেবব্রত হালদার বিটু বলেন, ‘পেয়ারা আমাদের মৌসুমি আয়ের একমাত্র অবলম্বন। পেয়ারার ফলন ভালো হলে আমাদের স্বচ্ছলতা আসে। পানির উপরেই ভাসমান হাটে বছরে কোটি টাকা লেনদেন হয়। অস্থায়ী কিছু দোকান বসে পাইকার, পর্যটক বা দর্শনার্থীদের আপ্যায়নের বা ক্ষুধা নিবারণের মাধ্যমে ব্যবসা করে আর্থিকভাবে লাভবান হন বিক্রেতারা।’ কৃষক বিপুল চক্রবর্তি বলেন, ‘আমরা সংসারে ৩ জন পুরুষ পেয়ারা বাগানের পরিচর্যাসহ সব ধরনের কাজে নিয়োজিত থাকি। বছরের এ মৌসুমটাতে আমাদের আয় দিয়ে সারাবছর সংসার চলে।’ পর্যটক ব্যবসায়ী নিশিথ হালদার শানু বলেন, ‘পেয়ারার মৌসুমকে ঘিরে দেশি-বিদেশি পর্যটক আসেন। আগে শুধু নৌপথে আসতো। এখন পদ্মা সেতু হওয়ার পর সড়কপথে অল্প সময়ের মধ্যেই যাতায়াত করা যায়। তাই পর্যটকের সংখ্যা বাড়ছে। পেয়ারা বাগানের ক্ষতি হওয়ায় আমরা নান্দনিক ভ্রমণের সুযোগ করে দিয়েছি। পর্যটক বা দর্শনার্থীরা যাওয়ার সময় কিছু পেয়ারা কিনে নিয়ে যান বাড়ির জন্য।’ সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ভবেন হালদার বলেন, ‘এ বছর পেয়ারা গাছের পরিচর্যা সঠিকভাবে করা হলেও বৃষ্টি না থাকায় ফুল বেশিরভাগই ঝরে গেছে। গাছে যে পরিমাণ ফল হয়েছে, তাতে দাম ভালো পাচ্ছি কিন্তু খরচের তুলনায় খুবই কম।
ঝালকাঠি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মনিরুল ইসলাম জানান, জেলার সদর উপজেলায় ১৩ গ্রামে ৩৫০ হেক্টর জমিতে বাণিজ্যিকভাবে পেয়ারা চাষ হয়। পেয়ারা মৌসুমে এলাকার মানুষের কাছে ‘পেয়ারা’ অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য ও জীবিকার অবলম্বন। এবার ফলন কম হলেও চাষিরা ভালো দাম পাচ্ছেন।’ তিনি জানান, তাপদাহ ও অনাবৃষ্টির কারণে পেয়ারার ফলন কম হলেও পদ্মা সেতুর কারনে দাম অনেক বেশি পাচ্ছেন। এতে ক্ষতি পূষিয়ে উঠতে পারবেন। এ বছর হেক্টর প্রতি সাড়ে ১১ থেকে ১২ মেট্রিকটন পেয়ারার ফলন হয়েছে। প্রতিদিন প্রায় ৫ থেকে ৭ লাখ টাকার পেয়ারা বেচাকেনা হচ্ছে।
ঝালকাঠির পুলিশ সুপার আফরুজুল হক টুটুল জানান, পর্যটকদের নিরাপত্তা দিতে সার্বক্ষনিক মনিটরি করা হচ্ছে এবং টহল পুলিশ রয়েছে। ঝালকাঠির জেলা প্রশাসক ফারাহ গুল নিঝুম জানান, ভাসমান পেয়ারা হাটের সার্বিক নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা রক্ষায় ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনাসহ সব রকম প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।

আরআর/এমআর

বাংলাদেশ সময়: ২১:১৪:৪৬ ● ১৭৮ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ