প্রতিবন্ধী ইব্রাহিম হাওলাদার: শিক্ষার বাতিঘর

প্রথম পাতা » লিড নিউজ » প্রতিবন্ধী ইব্রাহিম হাওলাদার: শিক্ষার বাতিঘর
রবিবার ● ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৯


প্রতিবন্ধী ইব্রাহিম হাওলাদার
মেজবাহউদ্দিন মাননু ॥
প্রতিবন্ধী ইব্রাহিম হাওলাদারের বসবাস কিংবা সম্পত্তি বলতেই ছিল দাদি জামিনা খাতুনের কাছ থেকে পাওয়া ৪০ শতক জমি। শেষ সম্বলটুকু স্কুলে দান করতে দ্বিতীয়বার ভাবেননি। শুধু নিজে নন বৃদ্ধ বাবা মতলেব হাওলাদারও সায় দিলেন ছেলের মতে। অন্ধকারে শিক্ষার আলো জ¦ালানোর এ মানুষটি আজ প্রতিবন্ধী। জানালেন, ইব্রাহিম হাওলাদার ৯০০ জনসংখ্যা অধ্যুষিত ২৩০টি পরিবারের বসবাস মিঠাগঞ্জ ইউনিয়নের বাইশাখলা গ্রামটিতে এসএসসি পাশ কেউ এখনও আছে কী না তা খুঁজতে হয়। নিজে এসএসসি পাশ করার আগে (১৯৮৯ সালে) তাল গাছ থেকে পড়ে গিয়ে দুই পা ভেঙ্গে চারটি বছর বিছানায় ছিলেন। একটু সুস্থ হয়ে প্রথমে ক্রাচে ভর দিয়ে এক-দুই পা হেটেছেন। এখন লাঠিতে ভর দিয়ে কোনমতে চলেন। একমাত্র সম্বল বসতঘরসহ জমিটুকু তাও স্কুলে দান করে নিঃস্ব হয়ে গেছেন। এক কথায় এখন ভূমিহীন। ১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠা করেন স্কুলটি। নাম দেন বাইশাখলা প্রাথমিক বিদ্যালয়। সেখানে ছিল উদারতার পরিচয়। নিজেদের নামে করেননি। ২০১৫ সালে জাতীয়করন হয়েছে স্কুলটি। এখন পাঁচজন শিক্ষক রয়েছেন। রয়েছে ১১০ জন ছাত্র-ছাত্রী। স্কুলের সামনের খাস জমিটুকু ভূমিহীন হিসেবে বন্দোবস্ত চেয়ে আবেদন করেছিলেন ইব্রাহিম হাওলাদার। কিন্তু তার ফাইলের চলনগতি ছিল না। ভূমি অফিসের সার্ভেয়ারসহ সবাই ওই জমি দুরের এক রেয়াজউদ্দিনকে বন্দোবস্ত দিয়েছে। তবে তিনি এখন সদয় হয়েছেন। তার দাগ পাল্টে অন্যত্র থেকে ওই পরিমান খাস জমি দেয়া হচ্ছে। আর এ জমিটুকু ইব্রাহিম হাওলাদারের নামে বন্দোবস্ত দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। চার জন শিক্ষক আর ইব্রাহিম হাওলাদার নিজে এবং তার বাবা মতলেব হাওলাদার অর্থ দিয়ে, শ্রম দিয়ে টিনশেড ঘর করে সেখানে অন্তত ২০টি বছর চালাচ্ছেন ক্লাশ। পাঠদানে সংকুলান হয়না। তবে আশার কথা একটি বহুতল স্কুল কাম আশ্রয়কেন্দ্র বরাদ্দ হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। দুই একদিনে কাজ শুরু হবে বলে জানালেন, উপজেলা প্রকৌশলী আব্দুল মান্নান।

ইব্রাহিমের ভাষ্য, ‘ আমি জমি দিয়ে বাবা এবং এইসকল শিক্ষক যখন স্কুলের জন্য কাজ করতাম তখন গ্রামের কিছু মানুষ উপহাসের ছলে বলতেন ‘মতলেবের কলেজ।’ এখন ওইসব মানুষ ম্যানেজিং কমিটির সদস্য হতে চায় বলে জানালেন এ শিক্ষানুরাগী মানুষটি। স্কুলটি এঁদের কাছে সন্তানের চেয়েও আপন হয়ে আছে। যখন শিশুরা স্কুলে আসে-যায়, শিক্ষকরা স্কুলে লেখাপড়া করায় তখন ইব্রাহিম হাওলাদারের প্রাণে শান্তির পরশ বয়। মনে প্রশান্তি নেমে আসে। বর্তমানে ইউনিয়ন ছাত্রলীগ সভাপতি নুর হোসেন তুহিন স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি। ইব্রাহিম হাওলাদার দাতা সদস্য। প্রধান শিক্ষক বিপ্লব বিশ^াস, সহকারী শিক্ষক সাবিনা আক্তার, অজুফা আক্তার, জোবায়দা বেগম ও ফাতেমা রোজী জানান, এ স্কুলটি এদের অবদান। তাঁদেও পচেষ্টায় প্রতিষ্ঠা হয়েছে। আজ প্রতিষ্ঠিত। তাঁদের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি এই গ্রামের শিশুদের পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়ার সুযোগ হয়েছে। স্কুলের খবর জানতে গেলে প্রতিবন্ধী ইব্রাহিম হাওলাদার ও তার বাবা মতলেব হাওলাদার যারপরনাই খুশি। খালে নৌকা ঠিক করে পার করে দিয়ে ফের বেড়ানোর অনুরোধ করে বললেন, করছি স্কুল। গ্রামের মানুষের সারাজীবন কাজে লাগবে। এ প্রতিবন্ধী মানুষ ইব্রাহিম হাওলাদার যেন শিক্ষার বাতিঘর হিসেবে এলাকায় এখন নন্দীত হয়ে আছেন। কত জন ছিলেন, যাদের অবস্থা, সঙ্গতি ছিল। ছিল অঢেল ধন-সম্পদ কেউ এগিয়ে আসেনি। কিন্তু এর সবটুকু দিয়ে নিজে নিঃশেষ হয়ে সমাজকে আলোকিত করতে এগিয়ে আসলেন এ মানুষটি। প্রশ্ন জাগে শারিরীক প্রতিবন্ধী এ ইব্রাহিম হাওলাদার প্রতিবন্ধী নন। এগিয়ে চলেছেন। বরং এ সমাজের অন্যরাই যেন এক ইব্রাহিমের কাছে থমকে আছে। রয়েছেন পিছিয়ে। অনুকরণীয় মানুষ ইব্রাহিম হাওলাদার শেখালেন, শিক্ষার বাতি কীভাবে জ¦ালাতে হয়। নিজেকে জ¦ালিয়ে।

কেএস

বাংলাদেশ সময়: ১৭:৪৩:৫৭ ● ৪৮৮ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ