
ইয়াছিন মোহাম্মদ
আজ থেকে ৫৫ বছর আগে, ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর- উপকূলের মানুষের জীবনে ভয়াল এক রাত। সেই রাতের স্মৃতি আজও আমার মা পিয়ারা বেগমের (৯০) চোখে ভাসে।
আমি তখন মাত্র ছয় মাসের শিশু। জন্ম আমার ভোলা জেলার চরফ্যাশন উপজেলার দক্ষিণ আইচা গ্রামে। মা যখন সেই দিনের কথা বলেন, আমি আজও স্তব্ধ হয়ে যাই- কীভাবে অলৌকিকভাবে আমি বেঁচে গেলাম!
মায়ের বর্ণনা অনুযায়ী, সেদিন সকাল থেকেই গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। দুপুরে বাতাসের গতি বাড়ে, বিকেল নাগাদ জোয়ারের পানি উঠতে শুরু করে। সন্ধ্যার মধ্যে উঠোনে হাঁটু সমান পানি। তখনো চরফ্যাশনে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোনো বেড়িবাঁধ তৈরি হয়নি।
রাত বাড়তেই জোয়ারের পানি ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ে। বাতাসের তীব্রতা এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, বাবা-মা বুঝে যান- আজ তারা বন্যার পানিতে ভেসে যাবেন। একমাত্র সন্তান আমি, তাই কীভাবে আমাকে বাঁচাবেন, সেই চিন্তায় তারা দিশেহারা।
কাঁচা ঘরের আশপাশে কোনো আশ্রয়কেন্দ্র নেই। মা আমাকে গরম কাপড়ে জড়িয়ে, বাবা মাচার ওপর উঠলেন। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই মাচাটিও পানিতে তলিয়ে যায়। তখন বাধ্য হয়ে তারা ঘরের চালার ওপর উঠে গেলেন।
বৃষ্টি, ঝড় আর জলোচ্ছ্বাস- সব মিলিয়ে ভয়াবহ অবস্থা। কখনো মা, কখনো বাবা আমাকে কোলে নিচ্ছেন।
হঠাৎ ঘরের চালাও ভেসে যেতে শুরু করে। একপর্যায়ে তা একটি খেজুরগাছের সঙ্গে ধাক্কা খেলে, বাবা-মা সাঁতরে গাছের চূড়ায় উঠে বসেন।
মায়ের ভাষায়- ‘আল্লাহর রহমতে খেজুরের কোনো কাঁটা আমাদের গায়ে লাগেনি।’
ভিজে কাপড়ে আমি কাঁপছিলাম। মা একটানা নিজের বুকের দুধ খাইয়ে যাচ্ছিলেন, যেন আমার শরীরে একটু উষ্ণতা থাকে। সারা রাত তারা গাছের ডালে ঝুলে ছিলেন, বাতাসের ঝাপটায় শরীরে খেজুর কাঁটার ব্যথা জমছিল।
মাঝেমাঝে মা পরীক্ষা করতেন- আমি এখনো বেঁচে আছি কি না। চোখ বন্ধ দেখে ভাবতেন হয়তো আমি আর নেই। তবু বুকের দুধ মুখে ধরিয়ে দিতেন- দেখতেন আমি চুষি কি না।
রাতের শেষ প্রহরে বাতাসের গতি এতটাই বেড়ে যায় যে, এক পর্যায়ে আমি মায়ের কোল থেকে ছিটকে জোয়ারের পানিতে পড়ে যাই। বাবা কোনোভাবে সাঁতরে গিয়ে আমাকে তুলে আবার মায়ের কোলে দেন।
ধীরে ধীরে ভোরের দিকে বাতাস থামতে শুরু করে, পানি নামতে থাকে। গাছ থেকে নেমে তারা দেখেন- ঘরের ভিটেমাটিও আর নেই।
সেই রাতের শেষে যে শিশু বেঁচে ছিল, সে-ই আজকের আমি- ইয়াছিন মোহাম্মদ।
আমার বাবা সরফত আলী ২০১৫ সালে মারা গেছেন। মা পিয়ারা বেগম এখনো জীবিত। সেই ভয়াল রাতে আমার নানী বন্যায় প্রাণ হারান।
আজ এই দিনে আমি সবার কাছে আমার মা-বাবার জন্য দোয়া চাই।
তারা এক শিশু সন্তানকে বাঁচাতে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে যুদ্ধ করেছেন- আমার চোখে তারা প্রকৃত বীর।
১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বরের সেই ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন।
আমি তাদের সবার আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।
– লেখক: সাংবাদিক ও সংগঠক