
জিয়াউদ্দিন চৌধুরী
হাল আমলের বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্কে ভাটা পড়া বা বৈরিতা নিয়ে কিছু বলতে গেলে আমাকে বহু আগের অর্থাৎ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপর দুটি ঘটনার কথা মনে হয়। এ ঘটনাগুলো তখন হওয়া স্বাভাবিক ছিল না বলে আমার মনে হয়েছিল, কিন্তু হয়েছিল আমার প্রত্যক্ষে। আমার প্রত্যক্ষ প্রথম ঘটনা ১৯৭১ ডিসেম্বর মাসের তৃতীয় সপ্তাহে ঢাকায় আর দ্বিতীয়টি ১৯৭৪ সালের মাঝেমাঝি পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়িতে।
১৬ ডিসেম্বরের বিজয় দিবসের পর ঢাকা হয়ে গিয়েছিল একটি আনন্দের শহর; কিন্তু সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খল। রাস্তায় রাস্তায় মিছিল, প্রায়ই সব তরুণের কারও হাতে রাইফেল (কেউ মুক্তিযোদ্ধা, আবার কেউ ষোড়শ বাহিনী), কিন্তু সবার হাতে বাংলাদেশের পতাকা (মানচিত্রসহ)। প্রথম দু-এক দিন ভারতীয় সেনাদের দেখা যেত সামরিক যানসহ, পুলিশ ছিল সামান্য। কিন্তু রাস্তায় ছিল অনেক বিদেশি সাংবাদিক, বিশেষ করে ভারতীয়। এই ভারতীয় সাংবাদিকদের মধ্যে একজনের আমার সঙ্গে পরিচয় হয়। আমি ধানমন্ডির যে বাড়িতে থাকতাম তার পাশের বাড়িতে। তিনি অত্যন্ত আগ্রহে আমাদের কাছ থেকে ১৯৭১-এর বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে জানতে চাইতেন। এই সাংবাদিক একবার আমাদের বললেন যে তাঁকে ভারতীয় সেনাকর্তারা ঢাকা সেনানিবাসে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে কয়েকজন বন্দী পাকিস্তানি সেনা অফিসারের সঙ্গে সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য।
তিনি ফিরে এসে আমাদের বলবেন তাঁর অভিজ্ঞতার কথা। তিনি উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বর্ণনা করলেন ঢাকা সেনানিবাসে যাওয়া আর বন্দী পাকসেনাদের সঙ্গে দেখা করার ঘটনা। তিনি তাঁদের কী প্রশ্ন করেছিলেন বা কী উত্তর পেলেন, সে সম্পর্কে বিশেষ কিছু বললেন না। কিন্তু শেষের দিকে তিনি আমাদের বললেন, ‘জানেন, একজন উচ্চ পদের অফিসার আমাকে একটি অদ্ভুত কথা বললেন আমি উঠে আসার সময়? তিনি আমাকে বলল, তুমি ভারতীয়। বাঙালিদের তুমি চেনো না। আজ বাঙালিরা আমাদের যেভাবে তাড়িয়ে দিচ্ছে কিছুদিন পর তোমাদেরও তাড়াবে তারা। আচ্ছা এ কথা কেন বলল, বলতে পারেন?’ সাংবাদিক অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন। আমি শুধু বললাম, ‘এটা বোধ হয় তাঁর ক্ষোভের কথা।’
দ্বিতীয় ঘটনাটি ১৯৭৪ জুলাইয়ে পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়িতে। সেখানে আমি গিয়েছিলাম বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে সড়কপথে ঠাকুরগাঁও মহকুমার বাংলাবান্ধা সীমান্ত দিয়ে। পাকিস্তান আমলে এ সড়কপথ বন্ধ ছিল। এই প্রতিনিধিদল গিয়েছিল ইন্ডিয়ান অয়েল কোম্পানির সঙ্গে আলোচনা করতে—জলপাইগুড়ি থেকে জ্বালানি তেল সড়কযোগে দিনাজপুর-রংপুরে কীভাবে আনা যায়। আমাদের আলোচনা চার দিন স্থায়ী হয়। আলোচনা হতো তেল কোম্পানির সম্মেলনকক্ষে। আমরা প্রতিদিন রেস্টহাউস থেকে সম্মেলনকক্ষে যেতাম আমাদের নিজস্ব সরকারি গাড়ি নিয়ে। আমার ছিল একটি ল্যান্ড রোভার। অন্যদের কাছে ছিল টয়োটা গাড়ি। আমাদের গাড়িগুলো পার্ক করা থাকত সম্মেলনকক্ষের গাড়ি পার্কে। আমাদের সঙ্গে তেল কোম্পানির যাঁরা আলোচনা করতেন, তাঁদের ছিল সব ভারতীয় গাড়ি। যেমন হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড বা অ্যাম্বাসেডর।
একদিন আমার চালক আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘স্যার, আমাদের দেশকে কি ভারত নিয়ে নিতে পারে?’ হঠাৎ তার মনে এ কথা জানতে চাইলে সে জানাল যে পার্কিংয়ের জায়গায় সে স্থানীয় ড্রাইভারদের বলাবলি শুনছিল আগের দিন। ড্রাইভাররা একজন আরেকজনের কাছে জানতে চাচ্ছিল বিদেশি গাড়িগুলো কোথা থেকে এসেছে। দ্বিতীয়জন বাংলাদেশ বললে প্রথমজন আবার জিজ্ঞেস করে সে আবার কোথায়? তখন এক তৃতীয় ড্রাইভার বলে ওঠে, আরে বেটা এটা একটা নতুন দেশ হয়েছে, আগে অন্য দেশ ছিল। তবে চিন্তা করিস না, কিছুদিন পর ওটা আমাদের হবে সিকিমের মতো। এটা বলার পর আমার ড্রাইভার বেশ ভয়ের সুরে জিজ্ঞেস করল, ‘স্যার, এটা হতে পারে?’ আমি জোরে হেসে কথাটা উড়িয়ে দিয়ে বললাম, ওটা ওই হিন্দুস্তানি ড্রাইভারদের রসালাপ। কিন্তু আমার মনে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে কিছু বলতে গেলে এই সংলাপটি মনে পড়ে।
১৯৭৫–এর শেষের তিন–চার মাস শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, ভারতের জন্যও আশঙ্কাজনক ছিল, কারণ শেখ মুজিবের উত্তরসূরি খন্দকার মোশতাক কোনো বিদেশনীতি কেন দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রেও কোনো দৃঢ়তা দেখাতে পারেননি। যদিও ভারত নীরবে এ সময় বাংলাদেশের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিল, কিন্তু সে সময় ভারতের বাংলাদেশের ওপর হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা অনেকেই উড়িয়ে দেননি। কিন্তু ভারত কোনো হস্তক্ষেপ করেনি তখন, অন্তত দৃশ্যমানভাবে।
এই দুটি বর্ণনা যদিও দুই বছরের ব্যবধানে তবু ঘটনাগুলো ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ওপর ভারতের চিন্তার প্রতিফলন ঘটায়। স্বাধীনতাযুদ্ধ থেকে শুরু করে স্বাধীনতা–পরবর্তীকালে ভারতের প্রয়াস ছিল বাংলাদেশে এমন একটি সরকার থাকবে—এক. যে ভারতের পরম মিত্র হিসেবে থাকবে; দুই. বাংলাদেশে পাকিস্তানপন্থী তথা ধর্মীয় দলগুলোকে দমন করতে পারবে এবং তৃতীয় দেশের মধ্যে অবাধ বাণিজ্যের পরিবেশ সৃষ্টি করবে। ভারতের প্রথম লক্ষ্যের প্রধান স্তম্ভ ছিল ১৯৭২ সালের ভারত–বাংলাদেশ মৈত্রী চুক্তি। ২৫ বছর মেয়াদি এ চুক্তি সম্পাদিত হয় ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে সফররত ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আর শেখ মুজিবের স্বাক্ষরে। কিন্তু এ চুক্তি বাংলাদেশের অনেকে বিশেষ করে বামপন্থী দলের অপছন্দ ছিল।
ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চুক্তি নিয়ে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে বিশেষ আলোড়ন না তুললেও এর বিরুদ্ধে জাসদ এবং বাম রাজনৈতিক দলগুলো প্রায়ই কথা বলত। কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এ বিরোধিতা সফল হয়নি, কারণ ১৯৭২-৭৪ সালে আওয়ামী লীগ জাতীয় সংসদে বিপুল আধিপত্যে ছিল। কিন্তু এ সত্ত্বেও বাংলাদেশের জনমনে ভারতের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বেড়েই চলে। বিশেষ করে ভারতে ত্রাণসামগ্রী চোরাচালান, ভারতের থেকে মানহীন পণ্যদ্রব্য আমদানি এবং ব্যাপকভাবে ধান এবং পাট সীমান্ত দিয়ে পার হওয়ার অভিযোগে। এই সব মিলে এমন একটি পরিস্থিতি হতে থাকে যে স্বাধীনতার চার বছর শেষ হওয়ার আগেই বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব বেশ চাঙা হয়ে ওঠে। এর ফল হিসেবে যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে কতিপয় সেনাসদস্য হত্যা করে একটি অভ্যুত্থান ঘটায় এবং তার সরকারকে ভারতের তাঁবেদার হিসেবে আখ্যায়িত করে, এর প্রতিবাদে সাধারণ মানুষ রাস্তায় নামেনি।
১৯৭৫ সালের আগস্টের রক্তাক্ত ঘটনার পর সরকার পরিবর্তনের পর আশঙ্কা করা হয়েছিল যে ভারত বাংলাদেশের সম্পর্কে শুধু ফাটল না, ভারত হয়তো বাংলাদেশে সামরিক অভিযানের মাধ্যমে আবার একটি তাঁবেদার সরকার স্থাপনের প্রচেষ্টা করতে পারে। কিন্তু ভারতের তৎকালীন সরকারের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির কারণে ভারত–বাংলাদেশের পরিস্থিতি বেশ কিছুদিন পর্যবেক্ষণ করে এবং দুই দেশের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক রক্ষা করে।
মোটামুটি স্বাভাবিক সম্পর্ক পরবর্তী দুই দশক চলতে থাকে দুদেশের মধ্যে। যদিও এ সময় দুজন সামরিক অধিনায়ক বাংলাদেশের সর্বময় কর্তা ছিলেন, কিছুটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। ১৯৯১ সালে এরশাদ সরকার পতনের পর আবার পূর্ণ গণতন্ত্র ফিরে এলে জিয়াউর রহমান গঠিত জাতীয়তাবাদী দল যখন এক কালের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী জামায়াতে ইসলামী দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সরকার গঠন করে, ভারত তাতে বেশ উদ্বিগ্ন হয়। কারণ, এর আগের দুটি সরকার সামরিক ব্যক্তিদের দ্বারা পরিচালিত হলেও তাদের সঙ্গে ভারত এক সমঝোতার মধ্যে ছিল (বাংলাদেশ–ভারত কোনো পরস্পরবিরোধী কাজ করবে না)।
ভারতের বাংলাদেশের প্রতি আকর্ষণ এবং সম্পর্কের উন্নতিতে নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে পরবর্তী নির্বাচনে যখন জাতীয়তাবাদী দল এবং জামায়াতে ইসলামী সমর্থিত সরকারকে সরিয়ে আওয়ামী লীগ জয়ী হয় এবং সরকার গঠন করে প্রথমবারের মতো ১৯৭৫–এর অভ্যুত্থানের পর। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এই সরকারের অদূরদর্শিতা এবং কিছু হঠকারী কার্যক্রমের জন্য পরবর্তী নির্বাচনে এ দলকে পরাভূত করে আবার জাতীয়তাবাদী দল সরকার গঠন করলে ভারত বাংলাদেশ সম্পর্ক তথৈবচ হয়ে পড়ে। বলা হয়ে থাকে, ২০০৬ সালের রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ভয়ংকর অবস্থা দুই দলের বিরাজমান পরিস্থিতি দেশে সামরিক হস্তক্ষেপের কারণ ছিল। পরবর্তী দুই বছর (২০২৬-২০০৮) দেশে যে সামরিক সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার স্থাপিত হয়, তার পেছনে যে কয়েকটি আন্তর্জাতিক শক্তি কাজ করেছিল, তাদের মধ্যে ভারত ছিল অন্যতম।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আবার ক্ষমতায় আসার পর ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নত হতে থাকে। শেখ হাসিনা ভারতের সঙ্গে একটার পর আরেকটা চুক্তি করেন, যার ফলে ভারত–বাংলাদেশ সম্পর্ক আরও দৃঢ় হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ছিটমহল হস্তান্তর, ট্রানজিট চুক্তি, বিদ্যুৎ আমদানি এবং বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের উত্তর–পূর্ব রাজ্যগুলোর সঙ্গে রেলসংযোগের প্রাথমিক চুক্তি। এর প্রায় সব কটি ভারতকে সুবিধা দেওয়া বলে অভিযোগ করা হয় বাংলাদেশের অনেক মহলে। আরও বলা হয়, ভারত বিশেষ করে মোদি সরকার আগ্রহী থাকে, যাতে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকেন।
কারণ, তার পরিবর্তে অন্য কোনো দল ক্ষমতায় এলে এ সুবিধাগুলো থেকে ভারত বঞ্চিত হবে। তাই বলা হয়, বাংলাদেশের পরবর্তী তিনটি নির্বাচনে (২০১৪,২০১৮, ২০২৪) ভারতের পরোক্ষ সমর্থনে শেখ হাসিনা নির্বাচনে কারচুপি করে ক্ষমতায় থাকেন। এগুলো শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় থাকতে সাহায্য করলেও দেশের সাধারণ মানুষকে শুধু তার বিরুদ্ধেই নয়, ভারতের বিরুদ্ধেও যেতে বাধ্য করে। এর চরম ফল আমরা দেখতে পাই গত বছরের জুলাই অভ্যুত্থানে, যার ফলে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয় এবং শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নেন। এর পরপর বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কে এত অবনতি ঘটে, যা আগে বাংলাদেশের ভারতবিদ্বেষ এই পর্যায়ে ছিল না। একইভাবে ভারতেও শুধু সরকারি আচরণে নয়, সংবাদমাধ্যমগুলোও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রচার তুঙ্গে ওঠে।
ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনে হামলার প্রতিবাদে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে, ৪ ডিসেম্বর ২০২৪
ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনে হামলার প্রতিবাদে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে, ৪ ডিসেম্বর ২০২৪
ভারতের সরকার বিশেষ করে বর্তমান সরকার বাংলাদেশের শুধু বন্ধুত্ব চাইত না, তারা সব সময় চাইত বাংলাদেশে এমন একটি সরকার, যা ভারতের চাহিদা অনুযায়ী কাজ করবে। ভারতের সঙ্গে প্রথম চার বছর বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক খুবই ভালো ছিল, কারণ শেখ মুজিব তাঁর প্রজ্ঞা আর তাঁর অসাধারণ ব্যক্তিত্ব দিয়ে ভারত সরকারকে সুকৌশলে এ সম্পর্ককে একটি সম্মানজনক পর্যায়ে রাখতে পেরেছিলেন। কিন্তু ভারতের এ মনোভাব দ্রুত পরিবর্তিত হয় শেখ মুজিবুর রহমানের আকস্মিক হত্যা এবং বাংলাদেশে সামরিক অভ্যুত্থানের পরে পরে।
১৯৭৫–এর শেষের তিন–চার মাস শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, ভারতের জন্যও আশঙ্কাজনক ছিল, কারণ শেখ মুজিবের উত্তরসূরি খন্দকার মোশতাক কোনো বিদেশনীতি কেন দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রেও কোনো দৃঢ়তা দেখাতে পারেননি। যদিও ভারত নীরবে এ সময় বাংলাদেশের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিল, কিন্তু সে সময় ভারতের বাংলাদেশের ওপর হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা অনেকেই উড়িয়ে দেননি। কিন্তু ভারত কোনো হস্তক্ষেপ করেনি তখন, অন্তত দৃশ্যমানভাবে।
ভারত–বাংলাদেশের সম্পর্কে কয়েকটি ব্যাপার ভারতের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম, ভারত যেহেতু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করেছে (কিছু ভারতীয়দের ধারণা, বিশেষ করে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম, যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ভারত সম্ভব করেছে), তাই বাংলাদেশ ভারতেবিরোধী হবে না, দ্বিতীয়, বাংলাদেশে এমন একটি সরকার থাকবে যে আন্তর্জাতিক এবং উপমহাদেশীয় কাজকর্মে ভারতের সমর্থন দেবে, তৃতীয়, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্যিক যোগাযোগ সুদৃঢ় করতে বাংলাদেশ সরকার সহায়ক থাকবে। এই তিন নীতি আপাতদৃষ্টে নিরীহ মনে হয়, কিন্তু অনেক লোক এতে ভারতের বাংলাদেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ বলে মনে করতেন এবং এভাবে জনমনে প্রচার ও চালান।
শেখ মুজিব সরকারের পতনের পর পরের ২০টি বছর দুজন সেনাবাহিনী প্রধান দেশকে শাসন করেন (প্রথমে সামরিক আইনে পরে তাদের নিজের সৃষ্ট রাজনৈতিক দল দিয়ে) তারা কেউ কিন্তু বাংলাদেশের প্রথম চার বছরের ‘ভারততোষণ’ নীতি অনুসরণ করেননি।
ভারত–বাংলাদেশ সম্পর্কে কয়েকটি বাস্তবতা মাথায় রাখতে হবে। প্রথম বাংলাদেশ কোনো ভুঁইফোড় দেশ নয়। এটি কোটি কোটি মানুষের আন্দোলনের ফল, যার সঙ্গে হাত দিয়েছিল ভারত। ভারতের সঙ্গে কোনো দিনই বাংলাদেশের কোনো আত্মিক বিরোধ নেই।
দ্বিতীয় বাস্তবতা হলো, ভারত বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিবেশী, যার ১ হাজার ৮০০ মাইল এলাকা ভারত দ্বারা বেষ্টিত। বাহ্যিক বা অন্তর্নিহিতভাবেও ভারত বাংলাদেশ একই ভূমিতে। এখানে বৈরিতার অর্থ আত্মঘাতী সম্পর্ক।
তৃতীয়, বাংলাদেশের ভাষা ও সংস্কৃতি যুগ যুগ ধরে ওপার বাংলা অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এখানে সংঘাত বা প্রতিকূলতার অবকাশ নেই। যে কারণে দুদেশের মধ্যে বৈরিতা সৃষ্টি হয় বা হচ্ছে, তা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উসকানির জন্য। ভারত আজ যদি বাংলাদেশকে নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে একজন ব্যক্তিবিশেষকে কিংবা কোনো একটি রাজনৈতিক দলকে তাদের একমাত্র মিত্র হিসেবে ভেবে থাকে, তা হবে একটি অপরিণামদর্শী নীতি।
লিখেছেন: জিয়াউদ্দিন চৌধুরী সাবেক সরকারি কর্মকর্তা
সূত্র: প্রথমআলো