মাস্টারপ্লানহীন কুয়াকাটায় স্থবির পর্যটন উন্নয়ন ও শিল্প বিনিয়োগ!

প্রথম পাতা » কুয়াকাটা » মাস্টারপ্লানহীন কুয়াকাটায় স্থবির পর্যটন উন্নয়ন ও শিল্প বিনিয়োগ!
মঙ্গলবার ● ২৪ অক্টোবর ২০২৩


মাস্টারপ্লানহীন কুয়াকাটায় স্থবির পর্যটন উন্নয়ন ও শিল্প বিনিয়োগ!

জাহিদ রিপন, কুয়াকাটা সাগরকন্যা অফিস॥

দেড় যুগ পেরিয়ে গেলেও এখনও প্রনয়ন করা হয়নি পর্যটন নগরী কুয়াকাটার উন্নয়ন মাস্টারপ্লান। ফলে স্থবির হয়ে পড়েছে বিনিয়োগ, জমি ক্রয়-বিক্রয়ে বাড়ছে সীমাহীন জটিলতা। অপরিকল্পিত উন্নয়ন, অব্যবস্থাপনাসহ অভ্যান্তরীন অবকাঠামোর উন্নয়ন না হাওয়ায় হতাশ বিনিয়োগকারী, পর্যটক। দ্রুত সমন্বিত উদ্যোগ নেয়া না হলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এ বেলাভূমি হারাবে পর্যটকদের আগ্রহ।
প্রকৃতির অপার নীলিমার সানিধ্যে একই সৈকতে দাড়িয়ে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার জন্য দেশী-বিদেশী পর্যটকদের কাছে আকর্ষনীয় হয়ে সাগরকন্যা কুয়াকাটা। পর্যটকদের উপস্থিতিতে এখন সারা বছর মুখরিত থাকছে এ বেলাভূমি। পর্যটকদের আগমনে স্থানীয় ও ক্ষুদ্র ও মাঝারী বিনিয়োগকারীদের হাত ধরে এখানে গড়ে উঠেছে আবাসনসহ পর্যটন সংশ্লিস্ট বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু একটি পর্যটক বান্ধব কুয়াকাটা গড়ে তুলতে ছিলনা কোন মাস্টারপ্লান। ফলে অপিরকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে নানা স্থাপনা। স্থবির হয়ে আছে নতুন বিনিয়োগসহ জমির ক্রয়-বিক্রয়। বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলে শুরু হয়নি ঢাকা-কুয়াকাটা মহাসড়কের চার লেন কিংবা ছয় লেনের কাজ। এক যুগেও র্নিমান হয়নি পর্যটন নগরী কুয়াকাটার দর্শনীয় স্থান যাতায়তের সড়ক। গত এক দশকে বালুক্ষয়ে শ্রীহীন হয়ে পড়েছে সৈকত। কমেছে সৈকতের প্রশস্থতা। স্থায়ী ভাঙ্গন রোধে এখনো নেয়া হয়নি কোন দৃশ্যমান প্রকল্প।
কুয়াকাটাকে একটি পরিকল্পিত পর্যটন নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে ২০০৮ সালে কুয়াকাটা উন্নয়ন মাস্টারপ্লান প্রণয়নে হাত দেয় সরকার। দীর্ঘ সমীক্ষার পর ২০১৪ সালে প্রনয়ন করা হয় একটি মাষ্টারপ্লান। কিন্তু নানা জটিলতায় আলোর মুখ দেখেনি এ প্রকল্প। পরবর্তীতে ওই প্রকল্প বাদ দিয়ে ২০১৭-১৮ সালে নতুন করে মাষ্টারপ্লান প্রনয়নে হাত দিয়েছে সরকার। কিন্তু শম্ভুক গতিতে চলছে এ মাষ্টারপ্লান প্রনয়নের কাজ। অভিযোগ উঠেছে, কুয়াকাটায় বিনিয়োগকারী কয়েটি আবাসিক প্রতিষ্ঠানসহ, বিনিয়োাগ পরিকল্পনাকারী বেশ কয়েকজন প্রভাবশালীর প্রতিষ্ঠানকে বানিজ্যিক সুবিধা দিতে নেয়া হয়েছে এমন উদ্যোগ। কয়েকটি সড়ক র্নিমানের রূপরেখা তৈরি করে তা বাস্তবায়নে ব্যস্ততা ছাড়া অন্য রূপকল্প তৈরি করতে পারেনি।
কুয়াকাটা ট্যুরিজম সেন্টারের নতুন এ মাস্টারপ্লানের আওতায় বরিশাল বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের উদ্যেগে ঢাকা-কুয়াকাটা মহাসড়কের বেড়িবাঁধ সংলগ্ন জিরো পয়েন্ট হতে সিকদার রিসোর্ট পর্যন্ত ১.৯ কিলোমিটার এবং সিকদার রিসোর্ট হতে নতুনপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় হয়ে চাপলি বাজার সংলগ্ন বেড়িবাঁধ (পূর্ব) পর্যন্ত ৭.২৬ কিলোমিটার মোট ৯.১৬ কিলোমিটার সড়ক র্নিমানের প্রস্তাবনা করেছে নগর উন্নয়ন অধিদপ্তর। ৬০ ফুট প্রসস্থ এ সড়ক প্রস্তাবনা বাস্তবায়নের জন্য গনশুনানী করেছে পরিকল্পনা প্রনয়নকারী প্রতিষ্ঠানটি। সড়কটি র্নিমানে কুয়াকাটার বিভিন্ন পয়েন্টে সাইনবোর্ডও স্থাপন করে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। দীর্ঘ বছর পর পুনরায় মাস্টারপ্লানের কাজে হাত দেয়ায় এতে ক্ষতির শংকায় পড়েছে স্থানীয়, ক্ষুদ্র ও মাঝারী বিনিয়োগকারীরা।
এদিকে মাস্টাপ্লান প্রনয়ন না হওয়ায় কুয়াকাটার ভূমি ক্রয়-বিক্রয়সহ স্থাপনা র্নিমানে বেঁধে দেয়া হয়েছে ’পারমিশন’ নামের জটিলতা। বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় থেকে পারমিশনের দীর্ঘ জটিলতা আর বিড়াম্বনায় হতাশ বিনিয়োগকারীরা। এতে স্থবির হয়ে পড়েছে এখানকার সকল ধরনের বিনিয়োগ। বিনিয়োগ পরিকল্পনায় যেসব ইনভেস্টর জমি ক্রয় করেছেন স্থাপনা র্নিমানের দীর্ঘ জটিলতার কারনে তারাও হতাশ হয়ে পড়েছেন। স্থানীয়, ক্ষুদ্র ও মাঝারী যেসব বিনিয়োগকারী পারমিশন নামের জটিলতাকে পাশ কাটিয়ে ভবন র্নিমানের চেস্টা করেছেন তারাও পড়ছেন আইনী বেড়াজালে। সূত্র জানায়, এক যুগ ধরে বিদ্যমান এ জটিলতার কারনে কুয়াকাটায় যে ২ শতাধিক আবাসিক স্থাপনা তৈরি হয়েছে এদের কারোই নেই ভবন র্নিমানের অনুমতিপত্র।
এদিকে পর্যটন বিবেচনায় কুয়াকাটাকে পৌরসভা ঘোষনা করা হলেও ভবন র্নিমানে অনুমতি প্রদানের ক্ষমতা তাদের নেই। পারমিশন নামের এই আইনী খড়গে তারাও কার্যত বন্ধী। ফলে ভবন কিংবা স্থাপনা র্নিমানের পর হোল্ডিং ট্যাক্স, ট্রেড লাইসেন্স প্রদান করেই ক্ষ্রান্ত পৌর কর্তৃপক্ষ। পারমিশন নামের এই আইনী জটিলতা বন্ধে বর্তমান পৌর প্রশাসন কিংবা জনপ্রতিনিধিদের নেই দৃশ্যমান কোন উদ্যোগ। ফলে জরুরী টাকার প্রয়োজনে কারো জমি বিক্রির প্রয়োজন হলেও উপায় নেই বিক্রি করার।
বিদ্যমান বিনিয়োগের সুরক্ষা দিয়ে দ্রুত একটি মাষ্টারপ্লান বাস্তবায়নের দাবী জানিয়ে কুয়াকাটা ইলিশ পার্কের সত্ত্বাধিকারী রুমান ইমতিয়াজ তুষার বলেন, সরকার চাচ্ছে কুয়াকাটায় দেশী-বিদেশী বিনিয়োকারী আসুক। কিন্তু সরকার নিজেই আবার প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে রেখেছেন। ২০১৪ সালে প্রকাশিত মাস্টাপ্লান প্রকাশের পর আশা ছিল সরকারের যে জমি প্রয়োজন তা রেখে বাকীগুলো ছেড়ে দিবে। কিন্তু তা হয়নি। বরং জমি ক্রয়-বিক্রয়, স্থাপনা নির্মানের জন্য এখন ’পারমিশন’ প্রয়োজন। বছরে পর বছর পার হলেও পারমিশন মিলেনা। ফলে যেসব বিনিয়োগকারী জমি কিনে রেখেছেন তারাও বিনিয়োগ উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছেন। এটা পর্যটনের উন্নয়নের জন্য একটি বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা।
সিকদার রিসোর্টে এন্ড ভিলা’স এর এজিএম মো. আল-আমিন বলেন, পদ্মা সেতু চালুর পর কুয়াকাটায় পর্যটকের ঢল নেমেছে। পর্যটকদের এই আকর্ষন ধরে রাখতে হলে দ্রুত মাস্টারপাøান বাস্তবায়ন করে বিনিয়োগ উম্মুক্ত করে দিতে হবে। অন্যথায় মুখ থুবরে পড়বে সম্ভাবনাময় এ পর্যটন কেন্দ্র।
নগর উন্নয়ন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা সাথে রাখাইন সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয়দের নিয়ে বৈঠকের কথা তুলে ধরে কেরানীপাড়ার বাসিন্দা উচো মাতবর বলেন, সরকারের নানা উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়নে অনেক জমি দান করেছি। এখন যে স্বল্প জমি রয়েছে সেখানে দারিদ্রতা, অভাবের সাথে সংগ্রাম করে ২৫টি পরিবার বসবাস করছি। এখান থেকে জমি নিলে পাড়া বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কাজেই পাড়া থেকে এক শতক জমি দেয়া হবেনা।
রাখাইন সম্প্রদায় কুয়াকাটা পর্যটনের অলংকার। তাদের ক্ষতি করে উন্নয়ন পরিকল্পনা কোন মানদন্ডেই বিবেচনা প্রসূত হতে পারেনা। এমন কথা উল্লেখ করে একই পাড়ার বাসিন্দা চিংথান বলেন, বসত বাড়ী বাদে যতটুকু জমি আছে, তা ভাড়া দিয়ে আমরা জীবিকা নির্বাহ করছি। মাথা গোজার ঠাঁইসহ এটুকু কেড়ে নিলে পরিবার পরিজন নিয়ে দুর্বিসহ জীবন কাটাতে হবে।
ক্ষুদ্র বিনিয়েগকারী আরিফ বলেন বলেন, এমন উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহন করতে হবে, যেখানে পর্যটনখাতে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্থ না হয়। পদ্মা সেতুর চালুর পর কুয়াকাটায় পর্যটকদের যে আগ্রহ ও অগমন ঘটছে সেটি যেন নস্ট না হয়।
কুয়াকাটা পৌর মেয়র আনোয়ার হাওলাদার বলেন, কুয়াকাটার অভ্যান্তরীন সড়কের ৮০ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। সৈকতে গাছ লাগানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ২০১৪ সালে প্রনীত মাস্টারপ্লান অনেক আগে তৈরি হয়েছে। বর্তমানে বাস্তবতার সাথে তার মিল নেই। সরকার নতুন ম্স্টাপ্লান নিয়ে কাজ করছে। আশা করছি শীঘ্রই গেজেট আকারে প্রকাশ হতে পারে নতুন মাষ্টারপ্লান।
পানি সম্পদ মন্ত্রালয়ের প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক বলেন, কুয়াকাটা সৈকতের বালুক্ষয়ে ভাঙ্গন প্রতিরোধে ৭৩০ কোটির একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এতে স্থায়ীভাবে ভাঙ্গন প্রতিরোধ হবে। পর্যটকদের চলাচলসহ বিশ্রামের জন্য সৈকতে মেরিন ড্রাইভ এবং বেঞ্চি তৈরি করে দেয়া হবে।

জেআর/এমআর

বাংলাদেশ সময়: ১৭:২২:২৯ ● ১৫২ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ