হরিণ শিকার অব্যাহত, সুন্দরবন রক্ষায় চরম চ্যালেঞ্জ

হোম পেজ » মুক্তমত » হরিণ শিকার অব্যাহত, সুন্দরবন রক্ষায় চরম চ্যালেঞ্জ
বৃহস্পতিবার ● ২ অক্টোবর ২০২৫


 

সুন্দরবনে থামছে না হরিণ শিকার: শিকারীদের নিত্যনতুন কৌশলে বন রক্ষায় চরম চ্যালেঞ্জ

মোঃ রোকনুজ্জামান শরীফ

বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্যের অন্যতম ভাণ্ডার। প্রায় ১০,০০০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই বনাঞ্চলের ৬,০১৭ বর্গকিলোমিটার বাংলাদেশে অবস্থিত, যেখানে বাস করে ৩৭৫ প্রজাতির বন্যপ্রাণী। কিন্তু এই জীববৈচিত্র্যের অন্যতম প্রাণী চিত্রা হরিণ আজ নির্মূলের ঝুঁকিতে। অবৈধ শিকার, পাচার ও নতুন নতুন কৌশলের কারণে সুন্দরবনের হরিণ এখন অস্তিত্ব সঙ্কটে।

 

শিকারীদের নতুন কৌশল ও চোরাশিকার চক্র

সুসংগঠিত শিকারি চক্রগুলো এখন স্টেইনলেস স্টিলের অদৃশ্য ফাঁদ, চেতনানাশক স্প্রে ও ছদ্মবেশ ব্যবহার করছে। তারা জেলে, মৌয়াল বা কাঠুরিয়া সেজে বনে প্রবেশ করে খণ্ড খণ্ড যন্ত্রাংশ নিয়ে গিয়ে ফাঁদ বসায় এবং পরে সেগুলো মাটির নিচে লুকিয়ে রাখে। বাগেরহাটের শরণখোলা, মোড়েলগঞ্জ, মোংলা, খুলনার দাকোপ এবং বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলায় সক্রিয় এসব চক্র রাতের আঁধারে শিকার অভিযান চালায়।

শিকার শেষে হরিণের মাংস পাচারের জন্য ব্যবহৃত হয় শরণখোলার সোনাতলা, পানিরঘাটসহ একাধিক রুট। স্থানীয় কিছু মাছের ডিপো মালিক ও শুটকি ব্যবসায়ীদের সহায়তায় এই অবৈধ বাণিজ্য আরো বিস্তৃত হচ্ছে।

 

বন বিভাগের সীমাবদ্ধতা ও বাস্তবতা

বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত প্রবেশ নিষেধাজ্ঞার সময়ও ১৮৯টি অভিযোগ, ৯৪টি মামলা ও ১৪৮ জন গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটে। উদ্ধার করা হয়েছে হাজার হাজার ফুট ফাঁদ ও ৪৯ কেজি হরিণের মাংস। তবুও শিকার বন্ধ করা যায়নি।

প্রতি বনরক্ষীকে প্রায় ১,৮০০ হেক্টর এলাকা পাহারা দিতে হয়, অথচ জনবল সংকট ভয়াবহ। বাগেরহাট পূর্ব বিভাগে ৪২৬ জন থাকার কথা থাকলেও আছে মাত্র ১৫০ জন। জোয়ারের সময় সাঁতার কেটে টহল দিতে হয়, প্রাণঘাতী বন্যপ্রাণীর ঝুঁকি নিয়েও তারা দায়িত্ব পালন করেন।

 

শিকার বন্ধে বাধা ও অর্থনৈতিক প্রলোভন

হরিণ শিকারের পেছনে মূল কারণ অর্থনৈতিক লাভ। মাংস কেজিপ্রতি ১,২০০–১,৮০০ টাকায় গোপনে বিক্রি হয়, আর চামড়া ব্যবহৃত হয় শোভাবর্ধক সামগ্রী হিসেবে। কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি ও রাজনৈতিক মহল এই চোরাশিকারে মদদ দিচ্ছেন। আপ্যায়নের জন্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও হরিণের মাংস সংগ্রহের আগ্রহ দেখান বলে অভিযোগ রয়েছে।

স্থানীয় দরিদ্র মানুষও জীবিকার তাগিদে শিকারে জড়িয়ে পড়ে। অপরদিকে, আইন প্রয়োগের দুর্বলতা ও বন বিভাগের সীমাবদ্ধতা শিকারিদের বেপরোয়া করে তুলছে।

 

বন কর্মকর্তাদের মতামত

করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাওলাদার আজাদ কবীর বলেন, হরিণের মাংস খাওয়াকে এখন অনেকেই গৌরবের বিষয় মনে করেন। নিষিদ্ধ হলেও আগাম টাকা দিয়ে শিকার উৎসাহিত করা হচ্ছে। কখনো কখনো শুকরের মাংসকেও হরিণের মাংস হিসেবে চালিয়ে দেয়া হয়। সচেতনতা ছাড়া এ শিকার বন্ধ সম্ভব নয়।

পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও বনরক্ষীরা কঠোর পরিশ্রম করছেন। কিন্তু অসাধু চক্র নতুন নতুন কৌশলে শিকার করছে। হরিণ রক্ষায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

 

করণীয় ও সুপারিশ

হরিণ নিধন বন্ধে জরুরি ভিত্তিতে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন- বন বিভাগের জনবল ও সরঞ্জাম বৃদ্ধি, দ্রুতগামী জলযান ও নিরাপত্তা সরঞ্জাম সরবরাহ, আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ ও শাস্তি নিশ্চিত করা, উন্নত প্রযুক্তি ও নজরদারি ব্যবস্থা, বনরক্ষীদের জন্য প্রণোদনা ও স্বাস্থ্যসেবা, স্থানীয় জনগণের মধ্যে সচেতনতা ও স্বেচ্ছাসেবী অংশগ্রহণ

সব শেষে বলব, সুন্দরবন শুধু বাংলাদেশের নয়, বিশ্বের প্রাকৃতিক ঐতিহ্যের অংশ। সেখানে হরিণ কেবল একটি প্রাণী নয়, গোটা বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্যের প্রতীক। অবৈধ শিকার বন্ধ না হলে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে। রাষ্ট্র, সমাজ ও নাগরিক সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া এই ধ্বংসযজ্ঞ থামানো সম্ভব নয়।

বাংলাদেশ সময়: ১৯:৩৩:৩৯ ● ১০২ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ