ভূমিকম্প আতঙ্কে রাজধানী- পদক্ষেপহীনতায় জীবন ঝুঁকিতে

হোম পেজ » সম্পাদকীয় » ভূমিকম্প আতঙ্কে রাজধানী- পদক্ষেপহীনতায় জীবন ঝুঁকিতে
শনিবার ● ২২ নভেম্বর ২০২৫


সম্পাদকীয়

রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সৃষ্ট ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্প শুধু মাটি কেঁপে ওঠার ঘটনাই নয়, বরং এক গভীর অপ্রস্তুতি ও অবহেলার বাস্তবতা তুলে ধরেছে। দেশের সবচেয়ে জনবসতিপূর্ণ ও ঘনবসতিপূর্ণ মহানগরী ঢাকা, যেখানে প্রতিদিন কোটি মানুষের জীবনযাপন, সেখানে একটি মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পেই সাধারণ মানুষের আতঙ্ক আর অসহায়ত্ব স্পষ্ট হয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, সরকারি কিংবা বেসরকারি পর্যায়ে এখনো পর্যন্ত কোনো সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ বা পরিকল্পনা দৃশ্যমান হয়নি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকায় ৮ বা ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হলে শুধু আতঙ্ক নয়, তৈরি হবে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় মানবিক বিপর্যয়। বাংলাদেশ ইনভেস্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ইন্ডাস্ট্রিজ-এর প্রেসিডেন্ট এম জি আর নাসির মজুমদারের আশঙ্কা অত্যন্ত কঠোর বাস্তবতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়- ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকার এক লাখেরও বেশি ভবন ধসে পড়তে পারে এবং পুরান ঢাকাকে সম্পূর্ণরূপে পরিত্যক্ত ঘোষণা করতে হতে পারে। ভয়াবহ এই সতর্কবার্তা কি কেবল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পোস্টে সীমাবদ্ধ থাকবে, নাকি রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের দৃষ্টিগোচর হবে?

২১ নভেম্বর সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে ২৬ সেকেন্ড স্থায়ী ভূকম্পনের পর রাজধানীর বহু ভবনে ফাটল দেখা গেছে বলে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশ হলেও এখন পর্যন্ত কোনো পূর্ণাঙ্গ যাচাই, বিল্ডিং অডিট বা ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা প্রকাশের পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। অথচ একটি উন্নত রাষ্ট্রে ভূমিকম্পের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই জরুরি জরিপ, ক্ষতিগ্রস্ত ভবন সনাক্তকরণ, উদ্ধার সক্ষমতা পর্যালোচনা এবং জনসচেতনতা কার্যক্রম শুরু হয়। আমাদের দেশে তার কোনো লক্ষণ নেই।

প্রশ্ন জাগে- আমরা কি কেবল ভাগ্য নির্ভর হয়ে থাকতে চাই? নাকি এখনই জেগে ওঠার সময় এসেছে?

বিল্ডিং কোড না মেনে ভবন নির্মাণ, পুরনো স্থাপনায় অতিরিক্ত তলা যোগ করা, অপ্রশিক্ষিত বাসিন্দা, জরুরি সেবা অদক্ষতা এবং সরকারি তদারকির অভাব- সব মিলিয়ে ঢাকা শহর যেন একটি অচলায়তনে দাঁড়িয়ে আছে। ভূমিকম্পের ঝুঁকি নিয়ে শিক্ষা নেই, অনুশীলন নেই, নেই সতর্কতায় বাস্তবায়নযোগ্য নীতিমালা। অথচ এম জি আর নাসিরের দেওয়া Drop-Cover-Hold On পদ্ধতি, জীবনের অত্যন্ত সহজ এবং গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা, যা গণমাধ্যম বা সরকারি উদ্যোগে আরও বেশি প্রচারের প্রয়োজন ছিল।

ভূমিকম্পের এ সতর্ক সংকেত আমাদের নতুন উপলব্ধির সামনে দাঁড় করিয়েছে- ‘প্রস্তুতি না থাকলে জীবন বাঁচা ভাগ্যের উপর নির্ভরশীল।’ এটি শুধুই একটি সমাজবিজ্ঞানী বক্তব্য নয়, এটি একটি রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা নীতি। এখনই প্রয়োজন, সরকার, সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস, নগর পরিকল্পনাবিদ, প্রকৌশলী, গণমাধ্যম এবং নাগরিকদের সমন্বিত উদ্যোগ।

প্রথমত, জরুরি ভিত্তিতে একটি ন্যাশনাল আর্থকোয়েক রেসপন্স অ্যাকশন প্ল্যান প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।

দ্বিতীয়ত, ঢাকার সকল আবাসিক, বাণিজ্যিক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য বাধ্যতামূলক ভূমিকম্প প্রস্তুতি মহড়া চালু করতে হবে।

তৃতীয়ত, ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করে প্রকাশ্যে তালিকা প্রদর্শন করতে হবে এবং বিল্ডিং কোড বাস্তবায়নে কঠোর নজরদারি নিশ্চিত করতে হবে।

ভূমিকম্প কখন হবে তা কেউ জানে না, কিন্তু প্রস্তুতি কখন নিতে হবে তা ঠিক আজই।

প্রকৃতি হুঁশিয়ারি দিয়েছে, এখন কাজ করার পালা রাষ্ট্র ও নাগরিকদের।

জীবন শুধু বাস করা নয়- জীবন মানে সচেতন থাকা।

বাংলাদেশ সময়: ১৫:২৩:৩২ ● ১০৭ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ