এটিএম বুথে এ্যান্টি স্কিমিং ডিভাইস নেই প্রতারক চক্র হাতিয়ে নিচ্ছে বিপুল টাকা

প্রথম পাতা » জাতীয় » এটিএম বুথে এ্যান্টি স্কিমিং ডিভাইস নেই প্রতারক চক্র হাতিয়ে নিচ্ছে বিপুল টাকা
মঙ্গলবার ● ৯ জুলাই ২০১৯


এটিএম বুথে এ্যান্টি স্কিমিং ডিভাইস নেই প্রতারক চক্র হাতিয়ে নিচ্ছে বিপুল টাকা

ঢাকা সাগরকন্যা অফিস॥

দেশের অধিকাংশ এটিএম বুথেই এ্যান্টি স্কিমিং ডিভাইস নেই। আর এ সুযোগে দেশী-বিদেশী প্রতারক চক্র হাতিয়ে নিচ্ছে বিপুল অংকের টাকা। তারা বিগত ৩ বছরের বিভিন্ন ব্যাংকের বুথ থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। দেশী-বিদেশী শতাধিক প্রতারক চক্র ওই অপকর্মের সাথে জড়িত। ওই চক্রের সদস্যরা বাংলাদেশের মতো বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ওভাবে প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। বিশ্বের কত দেশে কতটি সিন্ডিকেট এমন প্রতারণার সঙ্গে জড়িত তা নিশ্চিত হতে একটি শক্তিশালী আন্তর্জাতিক টিম গঠিত হয়েছে। সিআইডি পুলিশের সার্বিক সহায়তায় আন্তর্জাতিক ওই টিম এটিএম বুথ জালিয়াতির দায়ে বাংলাদেশে গ্রেফতার হওয়া বিদেশীদের পর্যায়ক্রমে জিজ্ঞাসাবাদ করতে যাচ্ছে। পুলিশ বিভাগ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিগত ২০১৬ সালে প্রথম প্রযুক্তিনির্ভর জালিয়াতির মাধ্যমে এদেশে এটিএম বুথ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার ঘটনা ধরা পড়ে। ওই বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি ইস্টার্ন ব্যাংক বনানী মডেল থানায় একটি মামলা দায়ের করে। মামলার অভিযোগে বলা হয়, অন্তত ২১ গ্রাহকের এ্যাকাউন্ট থেকে এটিএম কার্ড ক্লোন করে অন্তত ১০ লাখ টাকা তুলে নেয়ার ঘটনা ঘটেছে। এমন ঘটনার দুই দিন পর ১৪ ফেব্রুয়ারি ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেড (ইউসিবিএল) একই থানায় একই ধরনের অভিযোগে আরো একটি মামলা দায়ের করে। ওই মামলার অভিযোগে বলা হয়, ব্যাংকটির এটিএম বুথে স্কিমিং ডিভাইস বসিয়ে গ্রাহকের এটিএম কার্ডের তথ্য চুরি করে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার ঘটনা ঘটছে। তাছাড়া পল্লবী থানায় সিটি ব্যাংকের তরফ থেকে এমন অভিযোগে আরেকটি মামলা দায়ের হয়। পরবর্তীতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্র জানা যায় ইউসিবিএল ছাড়াও ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড ও সিটি ব্যাংকের ৬টি বুথে স্কিমিং ডিভাইস বসিয়ে তথ্য চুরি করে একইভাবে কার্ড বানিয়ে প্রায় ২১ লাখ টাকা তুলে নেয়ার ঘটনা ঘটে। স্কিমিং ডিভাইসটি অন্তত ১২শ’ এটিএম কার্ডের তথ্য সংগ্রহ করে। তারমধ্যে চক্রটি ৪০টি কার্ড তৈরি করে টাকা তুলে নিয়েছে। বাকি ১১শ’ ৬০টি কার্ড বানিয়ে টাকা তুলে নেয়ার প্রস্তুতি চলছিল।
সূত্র জানায়, পুলিশি তদন্তের ধারাবাহিকতায় ওই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি জার্মানির নাগরিক পিওটর স্কেজেফান মাজুরেক (৫০), সিটি ব্যাংকের তিন কর্মকর্তা মোকসেদ আলী মাকসুদ (৪৫), রেজাউল করিম শাহীন (৪০) ও রেফাত আহমেদ রনিকে (৪২) গ্রেফতার করা হয়। তাদের দেয়া তথ্য মতে, চক্রটি শুধু বাংলাদেশেই সক্রিয় নয়; বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও সক্রিয়। তারা শুধু ২০১৬ সালেই বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থাৎ বাংলাদেশী মুদ্রায় ১৬শ’ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। যার মধ্যে ২০১৬ সালেই চক্রটি বাংলাদেশ থেকে অন্তত এক শ’ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে দাবি করেছে। জালিয়াত চক্রটির সঙ্গে লন্ডন প্রবাসী পলাতক দুই বাংলাদেশী ছাড়াও চার বিদেশী জড়িত। পলাতকদের গ্রেফতারে ইন্টারপোলের সঙ্গে যোগাযোগ চলছে। পলাতক বিদেশীরা রোমানিয়া, বুলগেরিয়া ও ইউক্রেনের নাগরিক। আর গ্রেফতার বিদেশী পিওটর বিশ্বের ৪টি দেশে মোস্টওয়ান্টেড হিসেবে তালিকাভুক্ত। পিওটর মূলত জার্মানির নাগরিক। তিনি পোল্যান্ডের নাগরিক পরিচয়ে প্রতারণার উদ্দেশে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন।
সূত্র আরো জানায়, এদেশের অধিকাংশ এটিএম বুথে এ্যান্টি স্কিমিং ডিভাইস নেই। আর এই সুযোগটিই কাজে লাগায় দেশী-বিদেশী চক্র। তারা কার্ড প্রবেশ করানোর জায়গায় এবং এটিএম বুথের মনিটরের ওপরের দিকে সূক্ষ্ম ক্যামেরা বসিয়ে রাখে। সেই ক্যামেরায় ভিডিও হয় গ্রাহকের গোপন পিন নম্বর। ওই পিন নম্বর দিয়ে ক্লোন এটিএম কার্ড তৈরি করে এটিএম বুথ থেকে টাকা তুলে নেয় প্রতারক চক্র। বিগত ২০১৭ সালের ১০ মার্চ র‌্যাব-১০’র হাতে আন্তর্জাতিক এটিএম কার্ড জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত ১১ জন গ্রেফতার হয়। ওই চক্রের হোতা সোহেল। সে দুবাই থাকার সময় এরিন লিমো নামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক নাগরিকের মাধ্যমে এটিএম কার্ড জালিয়াতির কৌশল শেখেন। ওই বিদেশীই তাকে এটিএম কার্ড জালিয়াতির বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়। এরিক লিমো ১২ বছর ধরে কার্ড জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত। দুবাইতে ৫ বছর সোহেল এরিক লিমোর সঙ্গে কার্ড জালিয়াতি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। সোহেল ও পিটার নামের এক বিদেশী ২০১৭ সালে বিভিন্ন এটিএম বুথ থেকে ৬ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। পরে পিটার গ্রেফতার হয়। চক্রটির সঙ্গে আমেরিকা, কানাডা, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী আন্তর্জাতিক কার্ড জালিয়াত চক্রের যোগাযোগ আছে। সর্বশেষ চলতি বছর ১ জুন ডাচ-বাংলা ব্যাংকের খিলগাঁওয়ের এটিএম বুথ থেকে কার্ড জালিয়াতি করে তিন লাখ টাকা উত্তোলনের ঘটনায় ইউক্রেনের সাত নাগরিক- দেনিস ভিতোমস্কি (২০), নাজারি ভজনোক (১৯), ভালেনতিন সোকোলোভস্কি (৩৭), সের্গেই উইক্রাইনেৎস (৩৩), আলেগ শেভচুক (৪৬) ও ভালোদিমির ত্রিশেনস্কি (৩৭) ডিবি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়।
এদিকে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্যা নজরুল ইসলাম জানান, বিগত বছর এপ্রিলে হাতঘড়ির বিশেষ ডিভাইসে এটিএম কার্ডের তথ্য চুরি করে সেই তথ্য দিয়ে ক্লোন এটিএম কার্ড বানিয়ে টাকা তুলে নেয়ার সঙ্গে জড়িত শরিফুল ইসলাম নামের একজনকে গ্রেফতার করা হয়। তার কাছ থেকে উদ্ধার হয় বিভিন্ন ব্যাংকের ১৪শ’ ক্লোন এটিএম কার্ড, একটি ম্যাগনেটিক স্ট্রিপ কার্ড রিডার ও রাইটার, তিনটি পজ মেশিন, তথ্য চুরির কাজে ব্যবহৃত ডিজিটাল হাতঘড়ি, দুটি মিনিকার্ড রিডার ডিভাইস, ১৪টি পাসপোর্ট, ৮টি মোবাইল ফোনসেট, ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের একটি নেক্সাস ক্রেডিট কার্ড, তিনটি জাতীয় পরিচয়পত্র, একটি পরচুলাসহ নানা সরঞ্জাম। শরিফুল শুধু গেল বছরের শুরুতেই ব্র্যাক, সিটি, ইবিএল, ইউসিবিএল ও ব্যাংক এশিয়ার এটিএম কার্ড জালিয়াতি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। শরিফুল বিভিন্ন চেন শপে পজ মেশিন দিত। সে ওই মেশিনে বিশেষ ডিভাইস বসিয়ে দিত। গ্রাহকরা পজ মেশিনে ব্যাংকের এটিএম কার্ড পাঞ্চ করলে কার্ডের তথ্য থেকে যেত সেই ডিভাইসে। এভাবে গ্রাহকের এটিএম কার্ডের তথ্য চুরি করে ক্লোন এটিএম কার্ড তৈরি করত। আর সেই কার্ড দিয়ে এটিএম বুথ থেকে টাকা তুলে নিত। শরীফুল ইসলাম ডিপার্টমেন্টাল শপ স্বপ্নের বনানী শাখায় কাজ করত। সুবিধার জন্য বাম বা ডানহাতে বিশেষ ডিভাইসযুক্ত হাতঘড়িটি পরত। গ্রাহক যখন তার এটিএম কার্ডটি পজ মেশিনে দিত তখন যেকোন কাজের উছিলায় তার হাতঘড়িটি পজ মেশিনের সঙ্গে লাগাত। লাগানোর সঙ্গে সঙ্গে গ্রাহকের পজ মেশিনের যাবতীয় তথ্য ব্লু টুথের মাধ্যমে হাতঘড়িতে থাকা মিনি কার্ড রিডার ও স্ক্যানারে জমা হতো। পরে বাসায় গিয়ে তার ল্যাপটপ এবং ডিভাইসের মাধ্যমে কাস্টমারের তথ্যগুলো ভার্জিন কার্ড বা খালি কার্ডে স্থাপন করে ক্লোন এটিএম কার্ড বানাত। পরে সুবিধাজনক এটিএম বুথ থেকে টাকা তুলে নিত। তাছাড়া বুথে টাকা তোলার সময় সিসি ক্যামেরায় যাতে তার আসল চেহারা না ওঠে এজন্য সে বিশেষ ধরনের কালো সানগ্লাস ও পরচুলা ব্যবহার করত। অন্য চেহারা ধারণ করে এটিএম বুথ থেকে টাকা তুলে নিত।

এফএন/এমআর

বাংলাদেশ সময়: ২১:৩৫:২৭ ● ৪৪০ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ