যথেচ্ছ দখল ও পানিপ্রবাহের স্বল্পতায় মরে যাচ্ছে নদী

প্রথম পাতা » জাতীয় » যথেচ্ছ দখল ও পানিপ্রবাহের স্বল্পতায় মরে যাচ্ছে নদী
বৃহস্পতিবার ● ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯


যথেচ্ছ দখল ও পানিপ্রবাহের স্বল্পতায় মরে যাচ্ছে নদী

ঢাকা সাগরকন্যা অফিস॥

বাংলাদেশে এমন কোনো নদী নেই যা দখলের কবলে পড়েনি। জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনের তথ্যে জানা গেছে, দেশের ৪০৫টি নদীর মধ্যে সবকটিই দখল-সন্ত্রাসের কবলে। পানির অভাবে প্রতি বছরই দু-একটি করে নদী মরে যাচ্ছে বা শুকিয়ে যাচ্ছে। যা আমাদের দেশকে স্থায়ী মরুকরণের পথে নিয়ে যাচ্ছে। গ্রীষ্মকাল এলে নদী হয়ে পড়ে শুকনো খটখটে। প্রমত্তা পদ্মা, তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, বিশাল যমুনা পরিণত হয় শুকনো খালে। যথেচ্ছ দখলের পাশাপাশি উজানের পানি প্রবাহ ভয়াবহ ভাবে কমে, নদীতে পলি জমে, জলাধারগুলো ভরাট হয়ে একের পর এক মরে যাচ্ছে বাংলাদেশের নদীগুলো।
জীবন প্রবাহরূপী নদীগুলোর এই মরণদশার প্রধান কারণ হলো গ্রীষ্মকালে উজান থেকে পানিপ্রবাহ কমে আসা। বর্ষায় পানির গড় প্রবাহ ঠিক থাকলেও গ্রীষ্মকালে সব নদীর গড় প্রবাহ ভয়াবহভাবে কমে আসে। বাংলাদেশের নদীগুলোর জন্য গঙ্গা-মেঘনা-ব্রহ্মপুত্র (জেএমবি বেসিন) এই তিন অববাহিকার পানিই প্রধান ভরসা। বাংলাদেশের নদীর মূল ¯্রােতধারার প্রধান অংশ আসে ভারত হয়ে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের কারণে বাংলাদেশের নদীগুলো মরে যাচ্ছে। সূত্র বলছে, ভারত থেকে পানিপ্রবাহ আটকে দেয়াই বাংলাদেশে নদীমৃত্যুর প্রধান কারণ। ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ গঙ্গার পানি ভাগাভাগি নিয়ে ভারতের সঙ্গে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তির প্রস্তাবনার তিন নম্বর অনুচ্ছেদে বলা রয়েছে, ভারত ও বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক নদীগুলোর পানি ভাগাভাগি ও এসব নদীতে প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে দুই দেশের জনগণের সুবিধা বিবেচনা করে দেখা হবে। আবার, গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তির নয় নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, দুই দেশের সরকার ন্যায়বিচার, ন্যায্যতা ও কারো ক্ষতি করা নয়- এসব নীতিমালার আলোকে যৌথ নদীর পানি ভাগাভাগি করতে সম্মত আছে। সুতরাং এই চুক্তির আওতায় ভারত কোনভাবেই একতরফাভাবে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারে না। অথচ উজানে ভারত থেকে পানিপ্রবাহ কমে আসার কারণেই বাংলাদেশের নদীগুলো মৃত্যুর প্রহর গুণছে। গঙ্গায় ফারাক্কা বাঁধ দেয়ার ফলে গঙ্গা অববাহিকার পানি প্রবাহ কমে এসেছে। গ্রীষ্মে এ প্রবাহ আশংকাজনকভাবে কমে আসে।
অন্যদিকে, তিস্তা চুক্তি না করা এবং উজানে তিস্তা নদীতে ভারতের বেশ কয়েকটি বাঁধ দিয়ে পানি প্রত্যাহারের কারণে পানিপ্রবাহ গ্রীষ্মকালে বস্তুত শূন্যের কোটায় নেমে আসে। ভারতের সঙ্গে ৫৪টি অভিন্ন নদী থাকলেও পানি বণ্টন চুক্তি হয়েছে মাত্র একটি নদী পদ্মার। তিস্তা চুক্তি রাজনৈতিক কারণে আটকে রয়েছে। বাকি ৫২টির ব্যাপারে শুধু বৈঠকে আলোচনাই হয়। পানি বণ্টন চুক্তির কোন অগ্রগতি হয় না। দুই দেশের সরকার প্রধানদের মধ্যে দুই দফা চুক্তি স্বাক্ষরের উদ্যোগ নেয়ার পরও রাজনৈতিক কারণ দেখিয়ে পিছিয়ে দেয়া হয়েছে এ চুক্তি।
এদিকে, অপরিকল্পিত নদীশাসন, বাঁধ নির্মাণ, বড় নদীগুলোর সাথে ছোট ও শাখা নদীগুলোর মুখ বন্ধ হয়ে যাওয়া, প্রতিকূল পরিবেশ প্রভৃতি কারণে নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদীগুলো প্রচ- হুমকির মুখোমুখি। এছাড়া, নদীর জায়গা দখল করে আবাসন প্রকল্প ও শিল্প কারখানা গড়ে তোলার পাশাপাশি দোকানপাট ও বাজার হয়েছে। ঘড়বাড়ি করে স্থানীয়রাও নদী-খালের জমি অবৈধভাবে দখল করেছে। দখলে পিছিয়ে নেই সরকিারি বিভিন্ন সংস্থা, প্রতিষ্ঠানও।
বিগত ১ জুলাই প্রকাশিত হাই কোর্টের এক রায়ে নদী দখলকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে বলা হয়। দেশের সব নদ-নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণার পাশাপাশি নদ-নদীর সুরক্ষা ও সংরক্ষণে নদী রক্ষা কমিশনকে ‘আইনগত অভিভাবক’ ঘোষণা করা হয়। সেই রায়ের নির্দেশনা অনুযায়ীই নদী রক্ষা কমিশনের ওয়েবসাইটে নদী দখলকারীদের চিহ্নিত করে একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে সারা দেশে নদী, খাল-বিল, জলাশয়-জলাধার দখলকারীর সংখ্যা প্রায় ৪৭ হাজার। এই দখলকারীদের মধ্যে ব্যবসায়ী, প্রভাবশালী ব্যক্তি ছাড়াও রয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিবিদ ও শিল্প-কারখানা। ঢাকার আশেপাশের চারটি নদী, খাল, জলাধারের দখলকারী হিসেবে উঠে এসেছে বিভিন্ন শিল্প গ্রুপ ও আবাসন প্রকল্পের নাম।
নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হাওলাদার জানিয়েছেন, এ তালিকা এখনও অসম্পূর্ণ এবং দখলদারদের চিহ্নিত করার এ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে বলে। তিনি বলেন, সারা দেশে যত নদী আছে, তার সবগুলোই কোনো না কোনোভাবে অবৈধ দখলদারদের কবলে পড়েছে। এসব দখল উচ্ছেদে বছরব্যাপী ক্র্যাশ প্রোগ্রাম পরিচালনা করছে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা। কমিশন থেকে সব জেলা প্রশাসককে এ বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসকরা নদী দখলমুক্ত করতে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনার জন্য যন্ত্রপাতি সংগ্রহে আর্থিক বরাদ্দ চেয়ে চিঠি দিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে। কিন্তু পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানান মুজিবুর রহমান। পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ চেয়ে ভূমি মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জালের মতো বিছিয়ে থাকা এদেশের নদ-নদীর প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে আজও বিতর্ক রয়েছে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড ২০০৫ সালে বাংলাদেশের নদ-নদী শীর্ষক একটি গ্রন্থ প্রকাশ করে। সেখানে দেখানো হয় দেশে নদ-নদীর সংখ্যা ৩১০টি। এরপর ২০১১ সালে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড আরও খানিকটা অনুসন্ধান করে নদ-নদীর সংখ্যা উল্লেখ করেছে ৪০৫টি। এটাই এখন সরকারী হিসাব ধরা হয়। কোন কোন সূত্রমতে, নদীর সংখ্যা ২৩০টি। বেসরকারী হিসাবে দেশে, নদী সংখ্যা ৭শ’ থেকে ২ হাজার পর্যন্ত উল্লেখ করা হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন নদীর প্রকৃত সংখ্যা যাই হোক না কেন সব নদীই আজ হুমকির মধ্যে রয়েছে। এ নিয়ে কারো কোন দ্বিমত নেই।
তারা বলেন, নদীর পানির উৎসমুখ বন্ধ করে, ভরাট করে, দখল করে নদীকে মেরে ফেলছি। নদীর সঠিক পরিসংখ্যান থাকলে কেউ সহজে মেরে ফেলতে পারত না। নদীর যে কোন পরিবর্তন সূচিত হলে তখন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেত। দেশে এমন অনেক নদী আছে, যেগুলোকে সরকারী নদীর তালিকায় আনা হয়নি। জমির পুরনো দলিলে নদীর উল্লেখ আছে, এ রকম শত শত নদী চোখের সামনে দখল হচ্ছে। অনেক মাঝারি এবং বড় নদীর প্রাণ হচ্ছে আমাদের ছোট ছোট নদী। এই ছোট ছোট নদী উপনদী হিসেবে যুক্ত হয়ে মূল নদীপ্রবাহ বৃদ্ধি করে। এ কারণে ছোট নদীগুলোকেও বাঁচিয়ে রাখার বিকল্প নেই।
এছাড়া, নৌপথে পণ্য পরিবহন খরচ কম হওয়া সত্ত্বেও নাব্যতা না থাকায় নৌপরিবহনের আওতা ক্রমান্বয়ে কমছে। এ সমস্যার সমাধানে বড় নদীগুলোর তীর ভরাট করে নগরায়ন ও শিল্পায়নের উদ্যোগ নেয়ার পাশাপাশি নদীগুলোর গভীরতা বাড়ানোর কথা ভাবা হচ্ছে। তবে এ ধরনের পরিকল্পনা দীর্ঘমেয়াদি ও ব্যয়বহুল। নদীর পাড় টেকসই ভাবে বাঁধানো এবং নদীকে দূষণমুক্ত রাখা সম্ভব হলে এ মহাপরিকল্পনা দেশের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী নদীশাসন সম্ভব হলে বন্যা ও নদীভাঙনের হাত থেকে যেমন রক্ষা পাওয়া যাবে তেমনি নদীর পানি ধারণমতাও বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এফএন/এমআর

বাংলাদেশ সময়: ২২:২১:৪৬ ● ৪১৯ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ