
সাগরকন্যা প্রতিবেদক, কলাপাড়া (পটুয়াখালী)
জাতীয় মাছ ইলিশের অস্তিত্ব রক্ষা ও উপকূলীয় পরিবেশ সুরক্ষার দাবিতে পটুয়াখালীর কলাপাড়ার আন্ধারমানিক নদীতে অনুষ্ঠিত হলো নৌকাভিত্তিক গণশুনানি। সোমবার (১০ নভেম্বর ২০২৫) সকাল ১০টায় আয়োজিত এ শুনানিতে বক্তারা বলেন, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও বন্দরনির্ভর অপরিকল্পিত উন্নয়ন ইলিশের অভয়াশ্রম আন্ধারমানিক নদীকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে।
গণশুনানির আয়োজন করে প্রতিবেশ ও উন্নয়ন ফোরাম-পটুয়াখালী, প্রান্তজন, ক্লিন ও বিডব্লিউজিইডি। এতে অংশ নেন স্থানীয় জেলে পরিবার ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা।
বিচারক প্যানেলে ছিলেন বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের খেপুপাড়া নদী উপকেন্দ্রের উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও উপকেন্দ্র প্রধান ড. মোহাম্মদ আশরাফুল হক, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপকূলীয় অধ্যয়ন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রভাষক অসীম আবরার, বরিশাল বিভাগীয় পরিবেশ ও জনসুরক্ষা ফোরামের সদস্য শুভঙ্কর চক্রবর্তী, এডভোকেট সুভাস চন্দ্র দাস এবং প্রতিবেশ ও উন্নয়ন ফোরাম-পটুয়াখালীর সদস্য মেজবাহউদ্দিন মাননু।
আলোচনা করেন প্রতিবেশ ও উন্নয়ন ফোরাম-পটুয়াখালীর আহ্বায়ক অমল মুখার্জী এবং প্রান্তজনের নির্বাহী পরিচালক ও প্রতিবেশ ও উন্নয়ন ফোরাম-পটুয়াখালীর সদস্য সচিব তৌহিদুল ইসলাম শাহজাদা।
জেলেদের পক্ষে বক্তব্য দেন মন্নান পলহান, আব্দুর রব রাঢ়ী, আকলিমা, চন্দ্র ভানু ও জহিরুল ইসলাম।
জেলে আব্দুর রব রাঢ়ী বলেন, আমি প্রায় ৫৫ বছর ধরে মাছ ধরি। আগে রামনাবাদ নদীতে হাজারো জেলে পরিবার মাছ ধরে সংসার চালাত। কিন্তু পায়রা বন্দরের চ্যানেল খননের পর মাছ ধরা বন্ধ হয়ে গেছে, কেউ ক্ষতিপূরণও পায়নি। এখন আমাদের বেঁচে থাকাই কষ্ট।
আয়োজক সংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছর থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এসে দেশে ইলিশ উৎপাদন প্রায় ৪২ হাজার মেট্রিক টন কমেছে, যা গত ছয় বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। বরিশাল বিভাগে উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে প্রায় ২৩,৫০৯ মেট্রিক টন। একসময় অফুরন্ত ভান্ডার হিসেবে পরিচিত আন্ধারমানিক নদ আজ প্রায় ইলিশশূন্য হিসেবেও তারা উল্লেখ করেন।
বক্তারা জানান, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও বন্দরের অপরিকল্পিত উন্নয়নই এই সংকটের মূল কারণ। এসব অবকাঠামো থেকে নির্গত অপরিশোধিত শিল্প বর্জ্য ও গরম পানি সরাসরি নদীতে পড়ছে, যা ইলিশের প্রজনন ও বেড়ে ওঠাকে বাধাগ্রস্ত করছে। ফলে ইলিশ ছোট হচ্ছে ও স্থানান্তরিত হচ্ছে অন্যত্র।
এছাড়া বন্দরকেন্দ্রিক জাহাজ চলাচল বেড়ে যাওয়ায় ইলিশের বঙ্গোপসাগর থেকে নদীতে প্রবেশ পথ প্রায় অবরুদ্ধ। নদীতে একের পর এক সেতু নির্মাণ, শাখা নদীর মুখ বন্ধ হওয়া এবং তীর ভরাট করে বালু ফেলার ফলে নদীর নাব্যতা হ্রাস পেয়েছে। এতে ইলিশের প্রজনন ক্ষেত্র ও চলাচলের পথ মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
বক্তারা বলেন, এসব কারণে স্থানীয় জেলে পরিবারগুলো জীবিকা হারিয়ে পেশা বদলাতে বাধ্য হচ্ছে। অনেকেই মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
গণশুনানি থেকে যেসব দাবি জানানো হয়, সেগুলো হলো- বিদ্যুৎকেন্দ্রের বর্জ্য ও গরম পানি নদীতে ফেলার বিষয়ে আন্তর্জাতিক মানের কঠোর পরিবেশ নীতিমালা নিশ্চিত করতে হবে। ইলিশের প্রজনন ক্ষেত্র রক্ষায় মৎস্য বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুযায়ী অবকাঠামোগত পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। জাহাজ চলাচল ও নির্মাণকাজ যেন ইলিশের চলাচলের পথ বাধাগ্রস্ত না করে, তা নিশ্চিত করতে হবে। সব মেগা প্রকল্পের অনুমোদনের আগে পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন বাধ্যতামূলক করতে হবে। আন্ধারমানিক নদীর সীমানা চিহ্নিত করে দখল, দূষণ ও ভরাট বন্ধের পাশাপাশি পলি অপসারণের মাধ্যমে নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে হবে।
এইদকে, এই গণশুনানি আন্ধারমানিক নদী ও ইলিশের অভয়াশ্রম রক্ষায় দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে উদ্বুদ্ধ করবে বলে আয়োজক সংগঠনগুলো আশা প্রকাশ করেছে।