করোনাকালীন শিশুদের সমস্যা ও করণীয়

প্রথম পাতা » মুক্তমত » করোনাকালীন শিশুদের সমস্যা ও করণীয়
রবিবার ● ২৬ জুলাই ২০২০


ডাঃ মোঃ মনিরুজ্জামান, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা

বিশ্ববাসী নতুন একটি শব্দের সাথে পরিচিত হয়েছে ২০১৯ সালের শেষের দিকে। আর তা হল করোনা ভাইরাস। কোভিট-১৯ এটি একটি ভাইরাস যা স্তব্দ করে দিয়েছে পৃথিবীর প্রাণচাঞ্চল্য। করোনা ভাইরাসের কারণে আমরা প্রায় সকলেই ঝুকির মধ্যে আছি। তবে এ করোনার মধ্যে সবচেয়ে আশার কথা হল বাচ্চারা তেমন গুরতর আকান্ত হয়না, হলেও মৃত সংক্রামন ঘটে। বিজ্ঞানীরা এর প্রকৃত কারণ নির্ধারন করতে পারেন নি। তবে মনে করা হয় পাঁচ বছরের বেশী বয়সী শিশু এবং কিশোরদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভাইরাস মোকাবেলায় বিশেষভাবে কার্যকর। তারা হয়ত আক্রান্ত কিন্তু তাদের সংক্রামন মৃদু বা তাদের মধ্যে সংক্রামনের কোন লক্ষণ বা উপসর্গ থাকেনা। প্রাপ্ত বয়স্ক যে ভাবে ভাইরাসের সংস্পর্শে এসেছে, শিশুরা হয়তো সে ভাবে ততোটা সংস্পর্শে আসেনি। কারন তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও বন্ধ এ সময়। হাসপাতালে হাজার হাজার রোগীর মধ্যে কভিট ওয়ালা বাচ্চা একদম নাই বললেই চলে। কিন্তু একটা ঝুকি আছে। যদিও সংখ্যায় খুব কম। তবুও জানা জরুরী। এটা কভিট থেকে নয়। কভিট পরবর্তী জটিলতার ফল নাম দেওয়া হয়েছে PIMS-TS (Paediatric Multisysten Inflammatory Syndrom Temporally Associated with SARS- Cov) A_ev MIS-C (Multisystem Inflammatory Syndrom in Children).

লক্ষণ সমুহঃ-

ক.টানা তিন দিনের বেশী ১০০.৪ ডিগ্রি জ্বরের সাথে থাকে নিচের যে কোন একটি লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত বাচ্চাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবেন।

খ.চোখের প্রদাহ

গ.চামড়ায় লালচে দাগ

ঘ.মুখ গহবহরে লালচে দাগ

ঙ.গলার নিচের গ্রন্থি ফুলে উঠে

চ. পেটে ব্যথা বমিসহ পাতলা পায়খানা প্রায় ক্ষেত্রে বাচ্চাগুলোর বয়স ৫-১৫ কিন্তু ছোট বাচ্চাদেরও হচ্ছে।

সোনামনিদের অন্যরকম ঝুকিঃ-

১.করোনা ভাইরাস শিশু পুষ্টি ও স্বাস্থের উপর একটা প্রভাব ফেলে। দীর্ঘ লকডাউন এর কারণে বাবা-মায়ের আয় কমে গেছে এবং অনেকে বেকারত্বের স্বীকার হচ্ছে। সার্বিকভাবে অর্থনৈতিক কর্মকন্ডে যে ব্যঘাত ঘটেছে তাতে আমাদের দরিদ্র ও হত-দরিদ্রের সংখ্যা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আন্তজার্তিক সংস্থ্যা সেভ দ্যা চিলড্রেন তাদের প্রকাশিত এক প্রতিবেদন বলেছে প্রায় ৬০% শিশু কঠিন খাদ্য সংকটে ভুগছে এবং শিশুরা মারাত্বক অপুষ্টিতে আক্রান্ত হচ্ছে। অনেক বাবা মায়ের বেতন বন্ধ হয়ে গেছে, চাকরী চলে গেছে। সুতারং খাবার ঠিকমত আসছেনা। শিশুরা সুষম পুষ্টি পাচ্ছে না। সে কারণে শিশুরা লম্বায় বড় হওয়া, ওজন বাড়া এসব কমে যাচ্ছে। শিশু পুষ্টির অভাব হলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। অসুখ-বিসুখ লেগেই থাকে।

২. দীর্ঘ লকডাউন এর কারণে শিশু ঘরে বসে একাকিত্বে ভুগছে। এতে শিশুর বিকাশে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। একটা শিশু যখন হাটতে শিখে,  ছবি আকঁতে ও নাচতে শিখে। এসব জিনিস কিন্তু শিশু বিকাশের অংশ। এই পরিস্থিতিতে তা মারত্বকভাবে ব্যহত হয়। একটি শিশু আর একটি শিশুর সংস্পর্শে আসার সুযোগ নাই, স্কুলে, প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে তারা  নিজেদের মধ্যে মেলমেশায় সুযোগ পায় কিন্তু এ সময় তা হচ্ছেনা, ফলে সঠিকভাবে শিশুর বিকাশ বাধা গ্রস্থ হচ্ছে।

৩. শুধু ক্ষুধা অপুষ্টি ও বিকাশ জনিত সমস্যা ছাড়াও শিশুরা ঝুকির মধ্যে পড়বে আরো নানা ভাবে। দীর্ঘ লকডাউনে ব্যবসা বাণিজ্য, অর্থ নৈতিক কর্মকান্ড বন্ধ থাকার কারণে বেকার ও দরিদ্রের হার বৃদ্ধি পাওয়ায়, অভিভাবকদের অর্থ নৈতিক সমস্যার কারণে শিশুরা স্কুল থেকে ঝড়ে পড়বে। ফলে শিশু শ্রম, বাল্য বিবাহ ও পাচারের স্বীকার হবে। বাড়ীতে খাবার নাই। সুতারং শিশুরা ভিক্ষাবৃত্তিতে  জড়িয়ে পড়বে।

৪. শ্রেণীকক্ষে পাঠদান বন্ধ থাকায় শিশুর যে ঘাটতি হচ্ছে আগামী বছরে তা কাটিয়ে উঠা যাবেনা। দীর্ঘদিন বিদ্যালয় না যাওয়ায়র কারণে শিশুদের শিক্ষার আগ্রহ নষ্ট হচ্ছে। স্কুল যখন শুরু হবে তখন শিশুর উপর প্রচুর চাপ পড়বে যা তার মানসিক সম্যসার সৃষ্টি করবে।

৫. শিশুর আচরণগত পরিবর্তন ও মানসিক ত্রুটি ঘটছে করোনা ভাইরাসের কারণে। স্কুলে যাওয়ার সুযোগ নেই, তাই খেলার সুযোগ নেই। বন্ধুদের সাথে দেখা নেই। চার দেয়ারে মাঝে বন্ধী। তাই তাদের আচরণের মধ্যে পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। অকারণে বায়না ধরছে, কান্নাকাটি করছে। সব মিলিয়ে শুধু অপুষ্টি ও শিশু শ্রমের সাথে শিশুর মনে নিশ্চিতভাবে দীর্ঘ মেয়াদি একটি ট্রমা থেকে যাবে ।

করোনা ভাইরাসের করোনীয়ঃ-

১। বাড়িতে শিশু থাকলে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার উপর অবশ্যই নজর দিতে হবে।

২। শিশুরা যেহেতু মা-বাবা, দাদা-দাদি, ভাই-বোন, ঠাকুরমা এদের কাছে থাকে। তাই এদের থেকেই শিশুরা সংক্রামিত হওয়ার সম্ভবনা থাকে। তাই খুব ছোট বাচ্চাদের বারে বারে হাত ধুয়ে দিতে হবে এবং হ্যান্ডস্যানিটাইজার ব্যবহার করতে হবে। মা-বাবাদেরই বিশেষ করে যেসব শিশুরা হামাগুড়ি দেয়,  মুখে আঙ্গুল দেওয়ার স্বভাব এদের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে।

৩। যেহেতু ঘর বন্ধ শিশুরা বাইরে যেতে পারছেনা। তাই তাদের মনের উপর চাপ বাড়তে পারে। তাই পড়াশুনার  সাথে সাথে মা বাবাদের সময় দিতে হবে। তাদের সাথে খেলা করা, গল্পের বই পড়া, ভালো সময় কাটানোর দিকে নজর দিতে হবে। অর্থাৎ বাচ্চাদের সাথে সারাক্ষণ বন্ধু সুলভ আচারণ করতে হবে।

৪। করোনা ভাইরাস যদিও খাদ্যের সাহায্যে ছড়ায়না। তবুও ফুড সেপটির দিকে নজর দিতে হবে। খাবার যেই পাত্রে রাখা হয় বা যেখানে থাকবে সেসবগুলো পরিষ্কার রাখতে হবে।

৫। বিশেষ করে যারা স্বাস্থ্যকর্মী তাদের বাচ্চাদের দিকে বিশেষভাবে নজর দিতে হবে। যদি আলাদা থাকা সম্ভব না হয়। তবে বাহির থেকে ফিরে এসে ভালো ভাবে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করে জামা কাপড় পরিবর্তন করে বাচ্চাদের কাছে যেতে হবে।

৬। বাচ্চারা যাতে মোবাইল, টিভির প্রতি আসক্ত হয়ে না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

৭। যতদিন শিশুদের জন্য করোনা প্রতিরোধ ব্যবস্থা না হবে ততোদিন তাদের বিদ্যালয়ে ও খেলার মাঠে না পাঠালে তারা নিরাপদে থাকবে।

৮. শিশুর পুষ্টিকর খাবারের নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। সরকারীভাবে এবং আর্থিকভাবে স্বচ্ছল ব্যক্তিদের এ সময় এগিয়ে আসতে হবে। স্বাস্থ্য বিভাগের পুষ্টি কর্নারের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। এখানে ডঐঙ কর্তৃক সরবরাহকৃত ঋ-৭৫ এবং ঋ-১০০ নামক পুষ্টিকর খাদ্য পাওয়া যায়।

লেখকঃ  ডাঃ মোঃ মনিরুজ্জামান, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, বামনা, বরগুনা।

বাংলাদেশ সময়: ২১:০৫:৫২ ● ২০২১ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ