মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোর বকেয়া রাজস্ব আদায়ে কঠোর হচ্ছে এনবিআর

প্রথম পাতা » জাতীয় » মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোর বকেয়া রাজস্ব আদায়ে কঠোর হচ্ছে এনবিআর
মঙ্গলবার ● ১৯ ফেব্রুয়ারী ২০১৯


মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোর বকেয়া রাজস্ব আদায়ে কঠোর হচ্ছে এনবিআর

ঢাকা সাগরকন্যা অফিস॥

দেশে কর্মরত মোবাইল কোম্পানিগুলোর কাছে হাজার হাজার কোটি টাকা রাজস্ব বকেয়া রয়েছে। বর্তমানে ৬টি মোবাইল কোম্পানির কাছে সরকারের পাওনা প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা। ওই অর্থ পরিশোধের জন্য কোম্পানিগুলোকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে একাধিকবার চিঠি পাঠানো হয়েছে। এমনকি রাজস্ব আইন অনুসারে ওসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলাও করা হয়েছে। এখন রাজস্ব পরিশোধ না করলে মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোর হিসাব জব্দের মতো চূড়ান্ত পদক্ষেপ নেয়া হবে। চলতি অর্থবছরে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ে ২৭ হাজার ৯৯৯ কোটি টাকা ঘাটতি রয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা পূরণে এনবিআর থেকে রাজস্ব ফাঁকিবাজ বড় মাপের প্রতিষ্ঠানের চূড়ান্ত তালিকায় ৬টি মোবাইল কোম্পানিও আছে। তবে মোবাইল কম্পানিগুলোর সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল টেলিকম অপারেটরস অব বাংলাদেশ (অ্যামটব) থেকে দাবি করা হয়, এনবিআরের হিসাব সঠিক নয়। এনবিআর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, এদেশে কর্মরত মোবাইল ফোন কোম্পানি গ্রামীণফোন লিমিটেড, বাংলালিংক ডিজিটাল কমিউনিকেশন লিমিটেড, রবি আজিয়াটা লিমিটেড, এয়ারটেল বাংলাদেশ লিমিটেড, প্যাসিফিক টেলিকম বাংলাদেশ লি. (সিটিসেল) ও টেলিটক বাংলাদেশ লিমিটেডের বিরুদ্ধে এনবিআরের করা বেশির ভাগ মামলায় আপিল ট্রাইব্যুনাল সরকারের পক্ষে রায় দিয়েছেন। এখন ওসব মামলা উচ্চ আদালতে বিচারাধীন। তাছাড়া আপিল ট্রাইব্যুনালে শুনানি শেষে ২০টি মামলার রায়ে পাওনা রাজস্বের বিপরীতে এনবিআর প্রাথমিক দাবিনামা জারি করে চূড়ান্ত নোটিশ দিয়েছে। ইতিমধ্যে এনবিআর থেকে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে চিঠি পাঠিয়ে পুিঁজবাজারে তালিকাভুক্ত গ্রামীণফোনের কাছে এনবিআরের পাওনা রাজস্বের সমপরিমাণ অর্থ ব্যাংকে জমা রেখে বাকি অর্থ সরবরাহে আইনি পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। যাতে এনবিআর চূড়ান্ত আইনি প্রক্রিয়া শেষে চাওয়া মাত্রই বকেয়া পেতে পারে।
সূত্র জানায়, মোবাইল কোম্পানিগুলোর কাছে বকেয়া রাজস্ব হিসাবসম্পর্কিত এনবিআরের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদনে গ্রাামীণফোনের কাছে সিম রিপ্লেসমেন্ট খাতে এক হাজার ৪০২ কোটি ১৮ লাখ টাকা, স্থান ও স্থাপনা ভাড়া খাতে ২৩ কোটি ৮৬ লাখ টাকা এবং বিধিবহির্ভূতভাবে রেয়াত নেয়ায় ৯৪ কোটি ৯৯ লাখ টাকা পাওয়া। আর আইন বহির্ভূতভাবে রেয়াত সরকারের অনূকূলে সমন্বয় না করায় পাওনা ২৯ কোটি ১৫ লাখ টাকা। বিগত ২০০৬ সালের আগস্ট থেকে ২০০৭ সালের মার্চ পর্যন্ত সরবরাহকৃত  সিম কার্ডের ওপর প্রযোজ্য ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাবদ ৩৪৮ কোটি ৯ লাখ ৭১ হাজার ৬৯৪ টাকা প্রতিষ্ঠানটি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সরকারের কোষাগারে জমা না দেয়ায় মূসক আইন ১৯৯১-এর ৩৭ ধারার (৩) উপধারা অনুযায়ী মাসিক ২ শতাংশ হারে জরিমানাসহ পাওনা দাঁড়িয়েছে ৪৫২ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে গ্রামীণফোনের কাছে রাজস্ব পাওনা ২ হাজার ২ কোটি ৭১ লাখ টাকা। আর বাংলালিংকের কাছে সিম রিপ্লেসমেন্ট খাতে ৭০১ কোটি ৩৮ লাখ টাকা এবং বিধিবহির্ভূত রেয়াত নেওয়ায় ৭৮ কোটি ৯৪ লাখ টাকা পাওনা। কম্পিউটারে ধারণকৃত প্রকৃত সিম কার্ড ও ক্র্যাচ কার্ডের তথ্যের তুলনায় দাখিলপত্রে সরবরাহকৃত সিম কার্ড ও ক্র্যাচ কার্ড কম প্রদর্শন করায় পাওনা ৪৯ কোটি চার লাখ টাকা। তাছাড়া ২০০৬ সালের আগস্ট থেকে ২০০৭ সালের মার্চ পর্যন্ত সরবরাহকৃত সিম কার্ডের ওপর প্রযোজ্য মূসক ও সম্পূরক শুল্ক ১৬৪ কোটি ৬৪ লাখ ৮৫ হাজার ৪৪৯ টাকা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সরকারি কোষাগারে জমা না দেওয়ায় মাসিক ২ শতাংশ হারে অতিরিক্তসহ সরকার পাওনা হয়েছে ২২৮ কোটি ৪১ লাখ ৯৩ হাজার ৮৬৮ কোটি ১১ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে বাংলালিংকের কাছে পাওনা প্রায় এক হাজার ৫০ কোটি টাকা।
সূত্র আরো জানায়, রবি আজিয়াটা লি. এবং এয়ারটেল বাংলাদেশকে পৃথক দুটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাজস্ব পাওনার হিসাব করা হয়েছে। রবির কাছে রাজস্ব পাওনা সিম রিপ্লেসমেন্ট খাতে ৬৯৯ কোটি ৭৫ লাখ টাকা এবং বিধিবহির্ভূতভাবে রেয়াত নেয়ায় ২৩৭ কোটি ১৫ লাখ টাকা। ২০০৬ সালের আগস্ট থেকে ২০০৭ সালের মার্চ পর্যন্ত সরবরাহকৃত সিম কার্ডের ওপর প্রযোজ্য ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাবদ ১৮১ কোটি ৭৯ লাখ ৯৮ হাজার ১৮৩ কোটি ২৬ লাখ টাকা নির্ধারিত সময়ে সরকারি কোষাগারে জমা না দেওয়ায় মাসিক ২ শতাংশ হারে জরিমানাসহ পাওনা দাঁড়িয়েছে ২৬৬ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে প্রতিষ্ঠানটির কাছে মোট রাজস্ব পাওনা হয়েছে প্রায় এক হাজার ২০০ কোটি টাকা। আর এয়ারটেলের কাছে পাওনা সিম রিপ্লেসমেন্ট খাতে ১২৯ কোটি চার লাখ টাকা এবং স্থান ও স্থাপনা খাতে ১৬ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। এরিকসনের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী সম্পাদিত নির্মাণকাজে উৎসে মূসক কর্তন না করায় পাওনা দাঁড়িয়েছে ১১৭ কোটি পাঁচ লাখ টাকা। কম্পিউটারে ধারণকৃত প্রকৃত সরবরাহকৃত সিম কার্ড এবং ক্র্যাচ কার্ডের তথ্যের তুলনায় দাখিলপত্রে সরবরাহকৃত সিম কার্ড এবং ক্র্যাচ কার্ড কম প্রদর্শন করায় রাজস্ব পাওনা হয়েছে ৮৫ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। তাছাড়া মটরোলার সঙ্গে সম্পদিত চুক্তিতে সেবামূল্যে মূসক পরিশোধ না করায় আরো পাওনা ৩১ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে এয়ারটেলের কাছে পাওনা দাঁড়িয়েছে ৩৭৯ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। তাছাড়া সম্প্রতি এনবিআর থেকে প্যাসিফিক টেলিকম বাংলাদেশ লিমিটেডকে (সিটিসেল) পাঠানো চিঠিতে সরকারের রাজস্ব পাওনা ৮১ কোটি ২৬ লাখ টাকা পরিশোধ না করলে দায়িত্বরত ব্যক্তিদের সম্পদ ও হিসাব জব্দের কথা বলা হয়েছে। তার আগে প্রতিষ্ঠানটির আয়-ব্যয়সংক্রান্ত হিসাব জব্দ করা হয়। প্যাসিফিকের কাছে রাজস্ব পাওনা মূসক ও সম্পূরক শুল্ক যথাসময়ে পরিশোধ না করায় সুদ ও অর্থদ- হিসেবে ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ৯৮২ কোটি টাকা, ২০১৫ সালের মে মাসে ৮৪ লাখ টাকা এবং আইন ও বিধিবহির্ভূতভাবে রেয়াত গ্রহণ করায় ৪ কোটি সাত লাখ টাকা পাওনা হয়েছে। একই সঙ্গে ২০০৬ সালের আগস্ট থেকে ২০০৭ সালের মার্চ পর্যন্ত সরবরাহকৃত সিম কার্ডের ওপর প্রযোজ্য মূসক ও সম্পূরক শুল্ক আরোপ করায় ৪৭ কোটি ছয় লাখ ৪৪ হাজার ৪১৪ টাকার রাজস্ব পাওনা হয়েছে।
এদিকে রাজস্ব ফাঁকিবাজ প্রতিষ্ঠানের লেনদেন সম্পর্কে সম্প্রতি এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা শাখা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল (সিআইসি) থেকে  চেয়ারম্যানের কাঠে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, বকেয়া আদায়ে এনবিআর রাজস্ব ফাঁকিবাজ বড় মাপের প্রতিষ্ঠানগুলোর হিসাব জব্দের মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এ কারণে ওসব প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগই নিজস্ব তহবিলে সামান্য কিছু অর্থ রেখে বাকিটা ব্যাবসায়িক কারণ দেখিয়ে বিদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। এ প্রক্রিয়া চলতে থাকলে এনবিআর হিসাব জব্দ করলেও রাজস্বের অতি সামান্যই পাওয়া যাবে। ওই চিঠির পর এনবিআর সিদ্ধান্ত নিয়েছে অতি দ্রুতই বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি পাঠিয়ে ৬ মোবাইল কোম্পানির লেনদেনের ওপর কঠোর নজর রাখতে বলবে।
অন্যদিকে মোবাইল অপারেটরদের সংগঠন অ্যামটবের ব্যবস্থাপক (যোগাযোগ ও গবেষণা) আবদুল্লাহ আল মামুন মোবাইল কোম্পানিগুলোর বকেয়া রাজস্ব বিষয়ে জানান, আইনগতভাবে দাবি করা সব অর্থই মোবাইল অপারেটররা সরকারকে পরিশোধ করেছে। তবে যেসব দাবি আইনসংগত নয় এবং বিতর্কিত সেগুলো আদালতের বিবেচনায় আছে। আর বিচারাধীন কোনো বিষয়ে মন্তব্য করা সমীচীন নয়। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি এনবিআরের ওসব অযৌক্তিক দাবি বিনিয়োগকারীদের ওপর অযাচিত চাপ সৃষ্টি করছে।
এ প্রসঙ্গে এনবিআর চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন জানান, চলতি অর্থবছরের ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে বড় মাপের ফাঁকিবাজ প্রতিষ্ঠানের তালিকা করে রাজস্ব আদায়ে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। অনেক রাজস্ব ফাঁকিবাজ প্রতিষ্ঠান নিজস্ব তহবিলে এনবিআরের পাওনার চেয়ে কম রেখে বিভিন্ন অজুহাতে বিদেশে অর্থ পাঠিয়ে থাকে। ওসব প্রতিষ্ঠান যাতে সরকারকে ঠকাতে না পারে সে জন্য সতর্ক থাকা হবে। বকেয়া পরিশোধে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে বারবার তাগাদা দেয়া হচ্ছে। চিঠি দেয়া হচ্ছে। এনবিআর কর্মকর্তারা ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করে রাজস্ব পরিশোধে অনুরোধ করছেন। দেশের উন্নয়নের জন্য রাজস্ব পরিশোধের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হচ্ছে। তারপরও কেউ রাজস্ব পরিশোধ না করলে হিসাব জব্দের মতো কঠোর ব্যবস্থা নিতে এনবিআর বাধ্য হবে।


বাংলাদেশ সময়: ১৬:২৯:০১ ● ৪৮০ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ