মঙ্গলবার ● ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫
বেগম খালেদা জিয়া: একটি নক্ষত্রের পতন, অপূরণীয় শূন্যতা
হোম পেজ » মুক্তমত » বেগম খালেদা জিয়া: একটি নক্ষত্রের পতন, অপূরণীয় শূন্যতা

মোঃ রোকনুজ্জামান শরীফ
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস আজ এক শোকাবহ অধ্যায়ের মুখোমুখি। গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আপোষহীন নেতৃত্ব দেওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া আজ মঙ্গলবার সকালে মৃত্যুবরণ করেছেন। তাঁর প্রয়াণে দেশের রাজনীতি হারাল এক অভিজ্ঞ, দৃঢ় ও প্রভাবশালী নেতৃত্ব- যাঁর শূন্যতা সহজে পূরণ হওয়ার নয়।
গৃহিণী থেকে রাষ্ট্রনায়ক- বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উত্থান ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে এক ব্যতিক্রমী অধ্যায়। সামরিক শাসনের অন্ধকার সময়ে রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন গণতন্ত্রের দৃঢ় কণ্ঠস্বর হিসেবে। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, সংসদীয় রাজনীতি এবং বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তাঁর অবদান দেশ ও জাতির স্মৃতিতে চিরস্থায়ী হয়ে থাকবে।
বেগম খালেদা জিয়া শুধু একটি রাজনৈতিক দলের নেত্রী ছিলেন না; তিনি ছিলেন বিরোধী রাজনীতির এক শক্তিশালী প্রতীক। সংসদে কিংবা রাজপথে- ক্ষমতাসীনদের চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস ও দৃঢ়তা তাঁকে আলাদা করে চিনিয়েছে। তাঁর নেতৃত্বে বিএনপি বহু রাজনৈতিক ঝড়-ঝঞ্ঝার মধ্য দিয়ে গেছে, কিন্তু তিনি কখনো সহজ আপোষের পথে হাঁটেননি। এই অনমনীয় অবস্থানই তাঁকে সমর্থকদের কাছে শ্রদ্ধার এবং প্রতিপক্ষের কাছে সমীহের প্রতীকে পরিণত করেছিল।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়ার দ্বৈরথ এক অনিবার্য অধ্যায়। মতপার্থক্য, তীব্র রাজনৈতিক বিরোধ, আবার কখনো যৌথ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়েই এই দুই নেত্রীর রাজনীতি এগিয়েছে। প্রকাশ্য সংঘাত কিংবা নীরব প্রতিদ্বন্দ্বিতা- এই দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিন দেশের রাজনীতিকে গতিশীল রেখেছে। বেগম খালেদা জিয়ার প্রয়াণে সেই দ্বৈরথের এক পক্ষ চিরতরে থেমে গেল।
রাজপথের আন্দোলন, গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের সংগ্রাম এবং নির্বাচনী রাজনীতিতে তাঁর ভূমিকা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। সমালোচনা ছিল, অভিযোগ ছিল, বিতর্ক ছিল- কিন্তু ইতিহাস শেষ পর্যন্ত বিচার করে অবদানকে। সেই বিচারে বেগম খালেদা জিয়া স্মরণীয় হয়ে থাকবেন একজন সাহসী ও অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ হিসেবে, যিনি সংকটের মুহূর্তে কখনো পিছু হটেননি।
আজ তাঁর অনুপস্থিতিতে দেশের রাজনীতিতে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তা দিন দিন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সংসদ, রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনায় অভিজ্ঞ নেতৃত্ব কতটা অপরিহার্য- এই উপলব্ধি তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়েই নতুন করে সামনে এসেছে। একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ শুধু একটি দলের নয়, পুরো জাতিরই সম্পদ। সেই সম্পদ হারানোর বেদনা আজ সবার।
বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সহযোদ্ধা, বন্ধু ও প্রতিপক্ষ- সবার মধ্যেই আজ শোকের নীরবতা। রাজপথে যাঁরা একে অপরের বিরুদ্ধে কঠোর ভাষা ব্যবহার করেছেন, আজ তাঁরাই নীরবে চোখের জল ফেলছেন। রাজনীতির কঠোর বাস্তবতায় ব্যক্তিগত অনুভূতি অনেক সময় আড়ালে থাকে, কিন্তু মৃত্যুর সামনে সব বিরোধ ম্লান হয়ে যায়।
মানুষ চলে যায়, কিন্তু তার কর্ম, সিদ্ধান্ত ও সংগ্রামের স্মৃতি থেকে যায়। বেগম খালেদা জিয়ার জীবন ছিল সংগ্রামে ভরা- সেই সংগ্রাম কখনো প্রশংসিত, কখনো বিতর্কিত। তবুও ইতিহাসের পাতায় তাঁর নাম লেখা থাকবে গণতন্ত্রের লড়াইয়ের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে।
মহান আল্লাহ তায়ালা যেন তাঁর জীবনের সব ভুলত্রুটি ক্ষমা করে তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করেন- এই দোয়া আজ জাতির কণ্ঠে। বেগম খালেদা জিয়া নেই, কিন্তু তাঁর স্মৃতি, রাজনৈতিক উত্তরাধিকার এবং গণতন্ত্রের সংগ্রামে তাঁর ভূমিকা ইতিহাসের পাথেয় হয়ে থাকবে।
একটি নক্ষত্র নিভে গেল, কিন্তু তার আলো ইতিহাসের আকাশে বহুদিন জ্বলজ্বল করবে।
লেখক
মোঃ রোকনুজ্জামান শরীফ
সাধারণ সম্পাদক
মঠবাড়িয়া প্রেসক্লাব, পিরোজপুর
বাংলাদেশ সময়: ১৫:৪৭:৫৮ ● ৫৫ বার পঠিত
