
বিশেষ প্রতিবেদন, সাগরকন্যা ডেস্কঃ
২০২৫ সালের অন্যতম ভয়াবহ ও অনিশ্চিত যুদ্ধ পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান সংঘর্ষ। কয়েক দশকের শত্রুতা, ছায়াযুদ্ধ ও আঞ্চলিক দখলদারিত্বের রাজনীতির পর অবশেষে এই দুই শক্তিধর দেশ সরাসরি সামরিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে। তবে যুদ্ধের প্রথম ধাক্কাতেই ইরান সামরিক ও কৌশলগতভাবে বেশ চাপের মুখে পড়ে। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, যুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি, তবে প্রাথমিক ভারসাম্যে ইরান ব্যাকফুটে চলে গেছে।
আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণ: প্রথম রাউন্ডের হিসাব
২০২৫ সালের মে মাসের শেষ সপ্তাহে ইরান-সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোর ধারাবাহিক হামলা এবং ইরানের প্রকাশ্য হুমকির জবাবে ইসরায়েল সরাসরি ইরানের ভূখণ্ডে ব্যাপক বিমান হামলা চালায়। একের পর এক বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে তেহরান, ইসফাহান, শিরাজসহ গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলো।
ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান থেকে চালানো হামলায় আঘাত হানে:
রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ভবন, তেল ডিপো, সামরিক ঘাঁটি, নাতানজ পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্র। এর জবাবে ইরানও শতাধিক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ব্যবহার করে ইসরায়েলের হাইফা, তেলআভিভ ও দিমোনা পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায়। তবে ইসরায়েলের উন্নত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ‘আয়রন ডোম’ বেশিরভাগ হামলা প্রতিহত করে।
ক্ষতির পরিসংখ্যান: কে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত?
ইরান: নিহত: ৪০০+ (নারী ও শিশু অন্তর্ভুক্ত)
আহত: ১২০০+
ধ্বংস: রাষ্ট্রীয় টিভি ভবন, তেল মজুদাগার, নাতানজ পারমাণবিক স্থাপনার অংশবিশেষ
ইসরায়েল: নিহত: প্রায় ২৫ জন
আহত: ৩৫০+
ক্ষয়ক্ষতি: কিছু আবাসিক ভবন, শিল্পাঞ্চলে আগুন। এই পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট—ইরান কৌশলগত ও মানবিকভাবে ইসরায়েলের তুলনায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও কূটনৈতিক চাপ
জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র দুই পক্ষকেই সংযত হওয়ার আহ্বান জানালেও বেশি চাপ পড়ছে ইরানের ওপর। জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার ভলকার টুর্ক বলেন:
“এই যুদ্ধ কেবল দুই দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়—এর প্রভাব পুরো মধ্যপ্রাচ্য ও বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার ওপর পড়ছে।” যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের পাশে থাকলেও যুদ্ধ দীর্ঘায়িত না করার আহ্বান জানিয়েছে।
ইরানের অভ্যন্তরীণ সংকট
ইরান এমনিতেই চরম অর্থনৈতিক সংকটে আছে—মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব, আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা ক্রমাগত বাড়ছে। এর মধ্যে যুদ্ধ শুরুর ফলে জনগণের মাঝে অসন্তোষ বাড়ছে। বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, ইরানিরা যুদ্ধ নয়, শান্তি চায়। এই অভ্যন্তরীণ চাপের কারণে ইরান সরকার সরাসরি যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পথ থেকে কিছুটা সরে এসেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ইসরায়েলের বার্তা: প্রযুক্তি ও সাইকোলজিক্যাল জয়
ইসরায়েল কেবল প্রতিশোধ নেয়নি, বরং গোটা বিশ্বকে দেখিয়েছে—তারা ইরানের ভেতরে ঢুকে আঘাত হানতে সক্ষম। এই হামলা মনস্তাত্ত্বিকভাবে ইরানের ওপর এক বড় ধাক্কা। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি প্রযুক্তি, গোয়েন্দা এবং যুক্তরাষ্ট্রের ছায়া সমর্থনের একটি সমন্বিত ফল।
কৌশল বদলাচ্ছে তেহরান?
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইরান সরাসরি যুদ্ধের পথ থেকে কিছুটা সরে গিয়ে আবারও হিজবুল্লাহ, হামাস ও হুথিদের মাধ্যমে প্রক্সি যুদ্ধ শুরু করতে পারে। অর্থাৎ তেহরান সরাসরি সংঘাতে না গিয়েও ইসরায়েলের ওপর চাপ সৃষ্টি করার পথ খুঁজছে।
ভবিষ্যৎ শঙ্কা: থেমে থাকা মানেই শান্তি নয়
যুদ্ধ কিছুটা থেমে গেলেও একে স্থায়ী শান্তির ইঙ্গিত হিসেবে দেখা উচিত নয়। বরং বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি হতে পারে আরও বড় সংঘর্ষের প্রস্তুতির অংশ। পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা, আঞ্চলিক আধিপত্য ও মিত্রতা—সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এখনও জটিল।
মোটকথা হলো, এই মুহূর্তের যুদ্ধবিরতি বা ধীর গতি একপ্রকার কৌশলগত বিরতি মাত্র। ইরান হয়তো সাময়িকভাবে কাবু, কিন্তু ইতিহাস বলে—মধ্যপ্রাচ্য কখনোই দীর্ঘস্থায়ী শান্তির মুখ দেখেনি। আন্তর্জাতিক নেতৃত্বের এখনই সময় সজাগ হওয়ার—এই আগুন যাতে পুরো অঞ্চলকে গ্রাস না করে।