রবিবার ● ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫

বিজয়ের পথে ১৪ ডিসেম্বর বিজয়ের আগমুহূর্তে বুদ্ধিজীবী হত্যার জঘন্যতম অধ্যায়

হোম পেজ » মুক্তিযুদ্ধ » বিজয়ের পথে ১৪ ডিসেম্বর বিজয়ের আগমুহূর্তে বুদ্ধিজীবী হত্যার জঘন্যতম অধ্যায়
রবিবার ● ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫


 

ছবিটি সংগৃহীত

মো. মহসীন খান

ডিসেম্বর বাঙালির জীবনে অহংকার ও গৌরবের মাস। দিকে দিকে উড়তে থাকে বিজয়ের পতাকা। মহান এই মাসেই শত্রু-অধ্যুষিত বাংলার গ্রাম, গঞ্জ, শহর ও বন্দর একে একে মুক্ত হতে থাকে। প্রতিদিন নতুন নতুন মুক্ত এলাকায় বিজয়ের পতাকা উড়তে থাকে। বাঙালির বিজয় এবং পাকিস্তান ও রাজাকারদের পরাজয়ের মাস এটি।

আজ ১৪ ডিসেম্বর, রবিবার- বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে রাজাকার ও আল-বদরদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি হানাদাররা পরিকল্পিতভাবে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা করে। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের শেষ মুহূর্তে, বিজয়ের দোরগোড়ায় এসে ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড চালায় তারা। তালিকা তৈরি করে দেশের বরেণ্য শিক্ষক, সাহিত্যিক, শিল্পী, পেশাজীবী ও বুদ্ধিজীবীদের ঘর থেকে ডেকে নিয়ে একে একে হত্যা করা হয়।

একাত্তরের এই দিনে প্রাণ হারান ড. জিসি দেব, অধ্যাপক মনীর চৌধুরী, অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সার, ড. মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, ডা. ফজলে রাব্বী, ডা. আলীম চৌধুরী, নিজামুদ্দীন আহমেদ, সৈয়দ নাজমুল হক, আলতাফ মাহমুদ, ড. আবুল খায়ের, রশিদুল হাসান, ড. সিরাজুল হক খান, অধ্যক্ষ যোগেশ চন্দ্র ঘোষসহ আরও অনেকে।

নিহত বুদ্ধিজীবীদের অনেকের মরদেহ ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় পাওয়া যায় মিরপুরের জল্লাদখানা ও রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে। অনেকের দেহ আর কোনোদিনই উদ্ধার করা যায়নি।

একদিকে চলছে হত্যাযজ্ঞ, অন্যদিকে গভর্নর মালিক সেদিন সকালেই পরিস্থিতি বিবেচনায় গভর্নর হাউজে মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠক ডাকেন। বেলা ১১টার দিকে বৈঠক বসে। পাকিস্তানি ওয়্যারলেসে বৈঠকের সংবাদ ধরা পড়তেই তা পৌঁছে যায় মিত্রবাহিনীর হাতে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ভারতীয় বিমানবাহিনীর এক ঝাঁক জঙ্গিবিমান গভর্নর হাউজে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে বোমা বর্ষণ করে। পাঁচটির মতো বোমা গিয়ে পড়ে ভবনের ছাদের ওপর। বৈঠক চলছিল তখনও। মন্ত্রীরা, চিফ সেক্রেটারি, আইজিপিসহ উপস্থিত কর্মকর্তারা প্রাণ বাঁচাতে ছুটোছুটি শুরু করেন।

বিমান হামলা শেষ হলে গভর্নর মালিক পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের সঙ্গে আবার বৈঠকে বসেন। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই তারা পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন এবং তাৎক্ষণিকভাবে আন্তর্জাতিক রেডক্রসের প্রতিনিধি রেনডের কাছে আশ্রয় চান। ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলকে (বর্তমান রূপসী বাংলা হোটেল) রেডক্রসের অধীন ‘নিরপেক্ষ এলাকা’ ঘোষণা করা হয়। বহু বিদেশি এবং পশ্চিম পাকিস্তানি এই হোটেলে আশ্রয় নেন। ১৪ ডিসেম্বর গভর্নর মালিকও সদলবলে সেখানে চলে যান।

রেডক্রসের মাধ্যমে খবর পৌঁছে যায় জেনেভায়- পূর্ব পাকিস্তান সরকারের সর্বোচ্চ কর্মকর্তারা পদত্যাগ করেছেন এবং আশ্রয় নিয়েছেন। বিষয়টি ভারত ও বাংলাদেশ সরকার এবং ভারতীয় সামরিক বাহিনীকেও জানানো হয়।

গভর্নর মালিক ও তার পুরো প্রশাসনের এই পদত্যাগের পর জেনারেল নিয়াজির অবস্থান আরও দুর্বল হয়ে পড়ে। ঢাকার ওপর চলছে তীব্র আক্রমণ। প্রধান লক্ষ্য কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্ট। তারপরও নিয়াজি বলছিলেন, ‘আমি শেষ পর্যন্ত লড়ে যাব।’ মার্কিনিদের সমর্থনের ওপরই তার এই ভরসা।

রাজধানী ঢাকায় একাত্তরের এই দিনে চলছিল বুদ্ধিজীবী হত্যা- বাংলার চালিকাশক্তি বলে পরিচিত জ্ঞানী, প্রজ্ঞাবান মানুষদের নির্মমভাবে হত্যা করা হচ্ছিল। আর দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ধ্বনিত হচ্ছিল বিজয়ের সংবাদ। মানুষের আনন্দের অশ্রু আর স্বজন হারানোর কান্না একাকার হয়ে যাচ্ছিল।

 

– চলবে


লেখক: শিক্ষক ও সাংবাদিক

বাংলাদেশ সময়: ০:১২:২২ ● ৩৮ বার পঠিত