শনিবার ● ৪ মার্চ ২০২৩

দশমিনায় কদর নেই ডাক বাক্সের

হোম পেজ » পটুয়াখালী » দশমিনায় কদর নেই ডাক বাক্সের
শনিবার ● ৪ মার্চ ২০২৩


দশমিনায় কদর নেই ডাক বাক্সের

দশমিনা (পটুয়াখালী) সাগরকন্যা প্রতিনিধি॥

চিঠি দিও প্রতিদিন চিঠি দিও” একসময় গানে থাকা এ কথাগুলোই বুঝিয়ে দেয় চিঠির আবেদন জীবনের সঙ্গে ঠিক কতটা মিশে ছিল। প্রিয়জনের হাতে লেখা চিঠি কিংবা প্রিয়জনকে দেওয়া চিঠি দুইয়ের গুরুত্বই ছিল অনেক। কালের বিবর্তণে চিঠির আবেদন ফুরিয়েই গেছে। এখন আর লাল বাক্সে চিঠি জমা হয় না প্রিয়জনের জন্য।
ম্যাসেজ, ই-মেইল কিংবা ভিডিও কলের ওপর এতটাই মানুষ মজেছে যে হাতে লেখা চিঠির আর দরকারই পড়ে না তেমন একটা। নগর জীবনের ব্যস্ততায় হারিয়ে যেতে বসেছে চিঠির আবেদন। লাল রঙের ডাক বাক্সগুলো এখন পড়ে থাকে অবহেলায়। একসময় চিঠিপত্র ছিল যোগাযোগ মাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
যোগাযোগ মাধ্যমে ডিজিটালের ছোঁয়ায় ‘পত্র সাহিত্য’ বর্তমান যুগে বিলুপ্তপ্রায়। দূরবর্তী স্বজনের কাছে জরুরি বা আবেগ তাড়িত কোনো চিঠি লেখার প্রচলন প্রায় উঠেই গেছে। তার বদলে মানুষের কাছে এখন প্রিয় হয়েছে উঠেছে মুঠোফোন ও ইন্টারনেটভিত্তিক যোগাযোগ মাধ্যম। ফলে ডাক বাক্সের জৌলুস আর আগের মতো নেই।
ডাক বাক্সে চিঠি ফেলে দিয়ে কবে তার প্রিয়জন সেই চিঠি পাবেন সেই অপেক্ষা এখন আর কেউ করেন না। এই বাস্তবতা শুধু মৌলভীবাজারের ডাকঘরেই নয় দেশের প্রায় প্রতিটি ডাকঘরের ডাক বাক্সের একই চিত্র। দ্রুততম যোগাযোগ মাধ্যম এখন হাতের মুঠোয় থাকায় প্রত্যন্ত গ্রামের বধূও চিঠি লেখাকে সময় নষ্ট করা বলে মনে করেন। এভাবে কালের গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে প্রিয়জনের কাছে হাতে লেখা চিঠি আর জৌলুস ছড়ানো ডাক বাক্সের কদর। এখন ডাক বাক্সে সরকারি চিঠিপত্র ছাড়া আর কোনো চিঠিই পাওয়া যায় না। ফলে ধীরে ধীরে আবেদন হারাচ্ছে চিঠি নিয়ে রচিত আবেগ তাড়িত সব গান, কবিতা, সিনেমাগুলো।
শনিবারবার সকালে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়-কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পটুয়াখালীর দশমিনা পোস্ট অফিসের সামনে ডাক বাক্স। একসময় দেশে যোগাযোগের বাহন ছিল চিঠিপত্র আদান-প্রদান আর এ কাজটি করতো ডাক বিভাগ। জরুরি প্রয়োজনে, অফিস-আদালত, প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম, সামাজিক ও ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ডাক বিভাগের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যোগাযোগের অতিপ্রাচীন এই মাধ্যমটি ক্রমেই হারাচ্ছে তার ঐতিহ্য। ডাক বাক্স, পোস্ট মাস্টার আর ডাকপিয়নের সেই সোনালি অতীত আর সমাজ ব্যবস্থায় নেই। যদিও এই ডাক বিভাগ আজো তার ঐতিহ্য ও প্রয়োজনীয়তাকে ধারণ করে কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে।
যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যোগাযোগ মাধ্যমের আমূল পরিবর্তন হয়েছে। এনালগ প্রযুক্তির ব্যবহার ক্রমেই কমছে, বাড়ছে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার। কালের বিবর্তনে তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নে আধুনিক পদ্ধতির উদ্ভব হওয়ায় এখন দরকারি যোগাযোগ বা আপনজনের কোনো খবরের জন্য ডাকপিয়নের পথ চেয়ে বসে থাকতে হয় না। প্রিয়জন পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাক না কেন উন্নত প্রযুক্তির বদৌলতে মোবাইলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেকোনো ধরনের যোগাযোগ খুবই সহজলভ্য এবং মানুষের হাতের নাগালে এসে গেছে।
একসময় ফ্যাক্সের মাধ্যমে চিঠিপত্রের আদান-প্রদান করা হলেও বর্তমানে ই-মেইলের বহুবিধ ব্যবহারে ফ্যাক্সের ব্যবহারও দিন দিন কমছে। স্বল্প সময়ের মধ্যে আর্থিক লেনদেন আর দুঃসাধ্য নয়, খুবই সহজে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে এখন তা হাতের মুঠোয় বলা যায়। ডাক ব্যবস্থার সময় মানি অর্ডারের মাধ্যমে টাকা লেনদেন হতো। তবে ডাক বিভাগের আদলে বর্তমানে খুবই জনপ্রিয় মাধ্যম কুরিয়ার সার্ভিস। ডাক যোগাযোগের অনেক কাজ যেমন চিঠিপত্র, মালামাল পরিবহন এখন এই মাধ্যমে দেশে-বিদেশে পাঠানো অনেক সহজ, যদিও তা কিছুটা ব্যয়বহুল।
পোস্ট মাস্টার ও পিয়ন নিয়ম করেই ডাকঘরে আসেন, তবে কাজ না থাকায় কাটাতে হয় অলস সময়। হবে না’ই বা কেন? কেউ এখানে আর চিঠি পাঠাতে আসে না, মানি অর্ডার করতেও আগমন ঘটে না কারও। ৪০ কিংবা ৫০ বছর আগের চিত্রটা কিন্তু এ রকম ছিল না। তখন মানুষের আনাগোনা ও ডাকপিয়নের খট খট শব্দ চলত সারাদিন। লাইন ধরে কেউবা টাকা জমা দিতেন, কেউবা আবার টাকা নিতেন। অনেকে আবার আসতেন প্রিয়জনের কাছে চিঠি পাঠাতে।
সরকারি ভাবে কিছু চিঠিপত্র অবশ্য এখনও আসে এ ঠিকানায়। বিভিন্ন ধরনের গেজেট বা সরকারি প্রজ্ঞাপন, কখনও বা সরকারি চালান, চিঠিপত্র বিলি করে মাসিক কাজ টিকে আছে পুরানো এই ডাকঘর। নামমাত্র ডাক বাক্স টিকে আছে, তবে তার ব্যবহার আর নেই।
ডাক সংশ্লিষ্টদের মতে, বেসরকারি কোম্পানিগুলো চিঠি আদান-প্রদানে আধুনিক পদ্ধতি নিয়ে এলেও ডাক বিভাগ এখনো পড়ে আছে সেই আগের যুগেই। আর এ কারণেই মানুষ যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিচ্ছে কুরিয়ার সার্ভিসকে। প্রতাশিত সেবা না পাওয়ার ফলে ডাক সেবা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন সবাই। ডাকঘরগুলো টিকে আছে মানি ট্রান্সফার, সঞ্চয় গ্রহণসহ নানা বিকল্প সেবার মাধ্যমে। অযত্ম, অবহেলা আর অব্যবহৃত হয়ে শতাধিক ডাকঘরই অকার্যকর হয়ে পড়ে আছে। মাসের পর মাস খোলা হয়নি এমন ডাক বাক্সের সংখ্যাও কম নয়।
এবিষয়ে দশমিনা উপজেলার সদর ইউনিয়নের ১নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা আহম্মদ ইব্রাহিম অরবিল বলেন, ‘হাতে লেখা চিঠি ডাক বাক্সের মাধ্যমে পাঠিয়ে দিয়ে দূরের আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতাম। কিন্তু মোবাইল ও ইন্টারনেটের ব্যবহার দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকলে চিঠি লেখা বাদ দেই। তবে বর্তমান সময়ের ছেলে-মেয়েদের চিঠিপত্র আদান প্রদান করতে দেখা যায় না।’

এবিষয়ে দশমিনা পোস্ট অফিসের পোস্টম্যান মো. গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘১০-১২ বছর আগেও প্রবাসে থাকা স্বামী তার স্ত্রীর সঙ্গে হাতে লেখা চিঠির ম্যধ্যমে যোগাযোগ করত। কিন্তু ফেসবুক ম্যাসেঞ্জার, ইমো, ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপ ও ইমেইলের মাধ্যমে যখন থেকে সহজেই যোগাযোগ করা সম্ভব হলো তখন থেকেই কমে গেল চিঠিপত্র আদান প্রদান। এতে এখন আর সাধারণ মানুষের চিঠি আগের মতো আর আসে না তবে আসে শুধু সরকারি চিঠিপত্র।

এবিষয়ে দশমিনা পোস্ট অফিসের পোস্ট মাস্টার মো. সেলিম রেজা বলেন, ‘বর্তমানে পোস্ট অফিসে পার্সেল, বিমা, পরীক্ষার খাতা, মোবাইল মানি ওয়ার্ডারের মতো কাজগুলো হচ্ছে। আগের দিনের মতো এখন আর ব্যাপক ভাবে চিঠিপত্র লেনদেন হয় না। তবে এখনো কিছু লোকজন আদান-প্রদান করে থাকে।’

এসবি/এমআর

বাংলাদেশ সময়: ২১:৫৯:১৭ ● ২০৫ বার পঠিত