আগৈলঝাড়ায় ইউএনও অফিসে মালি’র দাপট!

প্রথম পাতা » বরিশাল » আগৈলঝাড়ায় ইউএনও অফিসে মালি’র দাপট!
সোমবার ● ২৬ মে ২০২৫


আগৈলঝাড়ায় ইউএনও অফিসে মালি’র দাপট!

গৌরনদী ও আগৈলঝাড়া (বরিশাল) সাগরকন্যা প্রতিনিধি॥

বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে মালি পদে মাস্টার রোলে নিয়োজিত তারিকুল ইসলাম হলুদ নামে এক ব্যক্তির দাপটে অতিষ্ঠ অফিস সহকারী ও সেবা গৃহীতারা।
সরকারি কাগজে মাস্টার রোলের তিনি একজন ‘মালি’ হলেও বাস্তবে মনে হচ্ছে পুরো ইউএনও অফিসের নিয়ন্ত্রণই যেন তার হাতে! সরকারি গোপন নথি ব্যবস্থাপনা, দাপ্তরিক কম্পিউটার ব্যবহার এমনকি জন্মনিবন্ধন সংশোধনের মতো স্পর্শকাতর কাজ সম্পাদনসহ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। এছাড়া অফিস সহকারীর নির্ধারিত চেয়ার ও কক্ষ জোরপূর্বক দখলে রাখার অভিযোগও উঠেছে তার বিরুদ্ধে।
মাস্টার রোলে সাধারণ একজন ‘মালি’ হয়েও কীভাবে দপ্তরের নিয়ন্ত্রণ হাতে নিলেন হলুদ? অনুসন্ধানে উঠে এসেছে তার পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক আশীর্বাদের বলয়। ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের আগৈলঝাড়া উপজেলা শাখার অন্যতম প্রভাবশালী সদস্য তার শ্বশুর বখতিয়ার শিকদারের রাজনৈতিক আশীর্বাদ এবং তৎকালীন সংসদ সদস্য হাসানাত আব্দুল্লাহর বিশেষ সুপারিশে তারিকুল ইসলাম হলুদ প্রথমে অস্থায়ীভাবে উপজেলা পরিষদে নিয়োগ পান। পরবর্তীতে ‘মালি’ পদে স্থায়ী নিয়োগের সুযোগ পেয়ে তিনি ধাপে ধাপে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দপ্তরের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক দায়িত্বের নিয়ন্ত্রণ দখল করে নেন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, অফিস সহকারীর জন্য নির্ধারিত অফিস কক্ষে চেয়ারে বসে রয়েছেন ‘মালি’ পদে নিয়োজিত তারিকুল ইসলাম হলুদ। তিনি কেবলমাত্র বসেই ছিলেন না তাঁর সামনে একটি ডেস্কে গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র সাজানো। সামনের চেয়ারে বসা দুইজন সেবাগ্রহীতা এবং পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আরও একজনকে তিনি দাপ্তরিক ভাষায় নির্দেশনা ও সহায়তা প্রদান করছিলেন। তার আচরণ, শরীরি ভাষা ও কার্যক্রম দেখে স্পষ্ট বোঝা যায় তিনি সেখানে একজন নি¤œপদস্থ কর্মচারী হিসেবে নয় বরং একজন প্রভাবশালী প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবেই কার্যভার সামলাচ্ছেন। এমনকি তার ডেস্কে থাকা কম্পিউটারে সরকারি সফটওয়্যার খোলা ছিল এবং সেখানে জাতীয় তথ্যভা-ার সংশ্লিষ্ট একটি ফর্ম সম্পাদনরত ছিলেন তিনি। অথচ বাস্তবতায় সরকারি কাগজপত্র অনুযায়ী তার পদমর্যাদা শুধুমাত্র একজন উদ্যান পরিচর্যাকারী বা মালি।
অফিস সহকারী মতিউর রহমান অভিযোগ করেন, সরকারি নিয়ম অনুযায়ী নিয়োগপ্রাপ্ত হলেও তিনি নিজের নির্ধারিত চেয়ারটি ব্যবহার করতে পারেন না। তার স্থলে মালি পদে কর্মরত হলুদ ওই চেয়ারেই বসে অফিসের যাবতীয় কাজ পরিচালনা করে যাচ্ছেন। মতিউর রহমানের এই বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট হয় একটি গভীর অসংগতি। যিনি সরকারি নিয়ম অনুযায়ী অফিস সহকারী পদে নিয়োগপ্রাপ্ত তিনি সরকারি কর্মস্থলে কোণঠাসা হয়ে আর যিনি নিছক একজন ‘মালি’ তিনিই প্রকাশ্যে ও নির্দ্বিধায় তার চেয়ার দখল করে দাপ্তরিক কাজ পরিচালনা করছেন।
শুধু অফিসের চেয়ার দখলই নয় বরং ইউএনও দপ্তরের আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে ইচ্ছেমতো দাপ্তরিক নথিপত্রে হস্তক্ষেপ এবং বয়স পরিবর্তনের নামে বয়স বাণিজ্য চালানোর অভিযোগ রয়েছে তারিকুল ইসলাম হলুদের বিরুদ্ধে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সরকারি কর্মকর্তা জানান, হলুদ নিয়মিতভাবে ইউএনও কার্যালয়ের প্রশাসনিক ইউজার আইডি-পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে জন্মনিবন্ধনের তথ্য পরিবর্তন করছেন। একজন অভ্যন্তরীণ কর্মকর্তা জানান, তারিকুল ইসলাম হলুদের মাধ্যমে বয়স সংশোধনের একাধিক উদাহরণ সরকারি ওয়েবসাইটেই সংরক্ষিত রয়েছে। এর মধ্যে দুটি পরিবর্তনের তথ্য সবচেয়ে দৃষ্টিকটু এবং প্রশ্নবিদ্ধ। যেখানে দেখা যায় এক ব্যক্তির প্রকৃত জন্মতারিখ ২ মার্চ ১৯৭৩ থেকে পরিবর্তন করে ৭ মার্চ ১৯৮২ করা হয়েছে অর্থাৎ পুরো নয় বছর বয়স কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এবং শুধু তাই নয়, সংশ্লিস্ট ওই ব্যক্তির স্ত্রীর জন্মতারিখেও আনা হয়েছে কৌশলী পরিবর্তন। আগে যেখানে স্ত্রীর জন্মতারিখ ছিল ৫ জুলাই ১৯৮৫ সেটি সংশোধন করে ২ মার্চ ১৯৮৫ দেখানো হয়েছে অর্থাৎ চার মাস এগিয়ে আনা হয়েছে। কোন শিক্ষাগত সার্টিফিকেট  ছাড়াই স্বামী-স্ত্রীর বয়স কমানো হয়েছে।
এ ধরনের বয়স পরিবর্তন কোনো নিরীহ ত্রুটি নয় বরং এটি নথিপত্র জালিয়াতির একটি উদ্বেগজনক উদাহরণ যা সংশ্লিষ্ট পরিচয়পত্র ও রেকর্ডের বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক অভিযোগ হলো, প্রতিদিন উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়ন থেকে ব্যাগভর্তি জন্মনিবন্ধন সংশোধনের আবেদন নিয়ে তারিকুল ইসলাম হলুদের হাতে সরাসরি জমা দেয় একটি সংঘবদ্ধ দালালচক্র। এসব আবেদনের যাচাই-বাছাই, তথ্য এন্ট্রি থেকে শুরু করে অনুমোদনের পুরো প্রক্রিয়াই সম্পন্ন করেন হলুদ নিজেই। অভিযোগ রয়েছে, নির্ধারিত অর্থের বিনিময়ে ইউএনও কার্যালয়ের সিস্টেমে প্রবেশ করে জন্মতারিখ অর্থাৎ বয়স কমানো বা বাড়ানোর এসব কাজ করে থাকেন হলুদ।
পরিষদে আসা রনবীর দাস জানান, আমার ছেলের বয়স এক বছর বাড়াতে ইউনিয়ন অফিসে গেলে আমাকে বলা হয় হলুদ সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। কিন্তু যোগাযোগ করতেই তিনি টাকা দাবি করেন।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত তারিকুল ইসলাম হলুদ নিজের পোস্ট টেকনিশিয়ান দাবী করে বলেন, আমার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন।  দাললিক কোন প্রমানাদি ছাড়াই একটি কুচক্রি মহল আমার নামে অপপ্রচার করে আসছে। কাজ না পারায় এক অফিস সহকারী কাজ আমি করি। তবে আমি কোন ফাইল করি না। তিনি অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আইডি স্যারের কাছে। কাজ তো আমি করি না কাজ স্যার করেন।
এ বিষয়ে আগৈলঝাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারিহা তানজিন সাংবাদিকদের জানান, তারিকুল ইসলাম হলুদ মালি পদে চাকুরী করেন। সে যদি কোন অনিয়ম করে থাকে তাহলে অবশ্যই সেটা খতিয়ে দেখা হবে।

 

 

এএসআর/এমআর

বাংলাদেশ সময়: ০:১৫:৪৪ ● ২৯ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ