পাবনায় করোনায় মৃতদের দাফনে পরমাত্মীয় স্বেচ্ছাসেবীরাই

প্রথম পাতা » ব্রেকিং নিউজ » পাবনায় করোনায় মৃতদের দাফনে পরমাত্মীয় স্বেচ্ছাসেবীরাই
সোমবার ● ২২ জুন ২০২০


পাবনায় করোনায় মৃতদের দাফনে পরমাত্মীয় স্বেচ্ছাসেবীরাই

পাবনা সাগরকন্যা প্রতিনিধি॥

পাবনায় করোনা আক্রান্ত কিংবা উপসর্গে মৃতদের শেষকৃত্য সম্পাদনে ভুক্তভোগী পরিবার ও প্রশাসনের আস্থা নির্ভরতায় পরিণত হয়েছেন একদল স্বেচ্ছাসেবক। ধর্মীয় রীতি মেনে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী তারা সৎকার করছেন সব ধর্মের মানুষেরই মরদেহ। করোনা মহামারীর দূর্যোগময় মূহুর্তে, সাহসিকতার অনন্য নজির স্থাপন করা এমন মানবিক কাজে তারা প্রশংসা পাচ্ছেন। আবার, করোনার মরদেহ নিয়ে স্থানীয় জনসাধারণের অজ্ঞতা ও আতঙ্কের কারণে বিড়ম্বনার শিকারও হচ্ছেন তারা।
জানা যায়, করোনার শুরুতে পাবনার বড় বড় রাজনৈতিক দলের নেতারা মরদেহ দাফনের দ্বায়িত্ব নেবার ঘোষণা দিয়ে প্রচারণা চালান। কিন্তু, প্রয়োজনের সময় তাদের কাউকেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। এ কাজে, জেলায় একমাত্র ভরসা কোয়ান্টাম ফাউণ্ডেশন ও তহুরা আজিজ ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবীরা। বিগত এক মাসে জেলায় করোনা আক্রান্ত কিংবা উপসর্গে মারা যাওয়া অন্তত ১৫ জনের মরদেহ সৎকার করেছেন তারা। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের সৎকার করা মরদেহের মধ্যে একজন খ্রিস্টান ও দুজন হিন্দু ব্যক্তিও রয়েছেন। আক্রান্ত হবার ভয়ে যখন তাদের স্বজন ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের কর্মীরাও মরদেহের শেষকৃত্য সম্পাদনে অপারগতা প্রকাশ করছে, তখনই পরমাত্মীয় পাশে দাঁড়াচ্ছেন পাবনার এই অকুতোভয় স্বেচ্ছাসেবীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ৮ জুন করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যান খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান একই হাসপাতালের নার্সিং ইনিস্টিটিউটের শিক্ষার্থী তামান্না। হাসপাতাল থেকে মরদেহ পাবনার আটঘড়িয়ার চাঁদভা ইউনিয়নের বাড়িতে আনা হলে প্রতিবেশীরা সমবেদনার পরিবর্তে শোকার্ত স্বজনদের সাথে অসদাচরণ করেন। স্থানীয় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের কর্মীরাও দাফনে রাজি না হলে, নিরুপায় তামান্নার পরিবার যোগাযোগ করে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনে। ধর্মীয় সকল আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে পরম মমতায় তামান্নাকে স্থানীয় গোরস্থানে দাফন করে যান সংগঠনটির স্বেচ্ছাসেবীরা।
তামান্নার চাচা সাইদুল ইসলাম বলেন, স্থানীয়রা সেদিন যে অবস্থার সৃষ্টি করেছিলো, তাতে কোয়ান্টামের ছেলেরা না এলে মরদেহ দাফন অসম্ভব ছিল। আমাদের পরিবার সারা জীবনের জন্য এই ছেলেদের কাছে ঋণী হয়ে রইলাম।
সম্প্রতি, শহরের ব্যাপ্টিস্ট মিশনের বাসিন্দা জেমস সুব্রত গোস্বামী করোনা উপসর্গে মারা যান। আতঙ্কে স্বজন ও সম্প্রদায়ের মানুষ শেষকৃত্যানুষ্ঠানে আসেনি। এক পর্যায়ে, কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়েই স্বে”্ছাসেবী দলের সহযোগীতা চায় পরিবার। বিস্মিত করে, ধর্ম পরিচয় ও সামাজিক সংকীর্ণতাকে তুচ্ছ করে যাজকের নির্দেশনায় খ্রীস্ট্রিয় রীতিতে পিতার সম্মানে তাকে সমাধিস্থ করে যায় কোয়ান্টামের মরদেহ সৎকার দলের সদস্যরা। পাবনায় করোনায় মারা যাওয়া দুজন সনাতন ধর্মাবলম্বীর মরদেহও সৎকারও করেছেন এই স্বেচ্ছাসেবীরা।
পাবনা ব্যাপ্টিস্ট মিশনের খ্রিস্টান কবরস্থান কমিটির সভাপতি কলিট তালুকদার বলেন, জ¦র, সর্দি , কাশির উপসর্গে সুব্রত গোস্বামীর মৃত্যুর পর প্রায় তিন ঘন্টা চেষ্টা করেও তার নমুনা পরীক্ষা করতে পারিনি। স্বেচ্ছাসেবকরা মুসলিম হওয়ায় তাই সঙ্কোচ বোধ করছিলাম, আদৌ তারা খ্রিস্টান ব্যক্তিকে সমাধিস্থ করবে কিনা! কিন্তু ফোন করা মাত্র আমাকে অবাক করে দিয়ে ছুটে আসেন তারা।
তিনি আরো বলেন, স্বেচ্ছাসেবীরা এই দুঃসময়ে যেভাবে কাজ করছে তা করোনাকালে স্বার্থপরতা আর অমানবিকতার বিপরীতে মানবিকতার অনন্য দৃষ্টান্ত, সাম্প্রদায়িকতা আর হিংসা বিদ্বেষে ভরা সমাজের জন্য নতুন এক শিক্ষা।
কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবী দলের দলনেতা তৌহিদুল ইসলাম বলেন, কদিনেই বিচিত্র অভিজ্ঞতায় পৃথিবীকে যেন নতুন করে চিনেছি আমরা। মৃত মানুষের কোন ধর্ম নেই, তার পরিচয় মানুষ। শেষ বিদায়ের সম্মান পাওয়ার অধিকার সবার রয়েছে। সে দায়বোধ থেকেই অসহায় মানবতার প্রয়োজনে মরদেহ সৎকার করছি আমরা।
এদিকে, করোনা আক্রান্ত রোগীদের মরদেহ দাফনে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবীদের কেউই করোনায় আক্রান্ত না হলেও তারা শিকার হচ্ছেন নানা সামাজিক বিড়ম্বনার।
তহুরা আজিজ ফাউন্ডেশনের পরিচালক দেওয়ান মাহবুব বলেন, দু একটি ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, মরদেহ দাফনে কাজ করার সময় মানুষ আমাদের দিকে এমন ভাবে তাকায় যেন আমরা কোন ভয়ঙ্কর জীব। সহযোগীতা তো দূরের কথা ফেরার পথে এলাকার রিক্সা ভ্যান চালকেরাও আমাদের নিতে চায় না। অথচ, সুরক্ষা নির্দেশনা মেনে স্বজন প্রতিবেশীরাই কিন্তু এসব মরদেহ দাফন করতে পারেন।
পাবনা জেলা প্রশাসক কবীর মাহমুদ স্থানীয়দের প্রতি মানবিক আচরণের আহবান জানিয়ে বলেন, আক্রান্ত রোগীর মরদেহ থেকে করোনা ভাইরাস ছড়ায় না। স্রষ্টা চাইলে যে কোন সময় যে কেউ করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যেতে পারেন। অথচ, এলাকায় মরদেহ দাফনে স্থানীয়দের রাজি করাতে প্রশাসন হস্তক্ষেপ করতে হচ্ছে। স্বেচ্ছাসেবীরা মরদেহ দাফনে যেভাবে রাত দিন প্রশাসনকে সহায়তা করছে, তাতে আমরা তাদের প্রতি আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ।

আরজে/এমআর

বাংলাদেশ সময়: ২১:৫৩:১৩ ● ৩৬১ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ